আদর্শ পিতা রাসূলুল্লাহ সা:

Printed Edition

মো: মোজাম্মেল হক

রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রেরিত এক সর্বোত্তম আদর্শ মানব। তিনি শুধু একজন মহান ধর্মীয় নেতা ছিলেন না; বরং একজন পরম স্নেহময় পিতাও ছিলেন। তাঁর পারিবারিক ও পিতৃত্বের দিকটি প্রতিটি মুসলিম পরিবারের জন্য অনুসরণীয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালে সাফল্যের প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সূরা আহজাব-২১)। এই আয়াতটি আমাদের শেখায়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণ করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।

রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন একজন আদর্শ পিতা, যিনি শুধু সন্তানের দৈহিক প্রয়োজন নয়, তাদের নৈতিক, আত্মিক ও মানসিক বিকাশেও গুরুত্ব দিতেন। তিনি সন্তানদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, ধৈর্য ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন, নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তাঁর পিতৃত্বের মূল ভিত্তি ছিল ভালোবাসা, নৈতিকতা ও আখিরাতের কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করা।

পুত্র ও কন্যাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সা:এর আচরণ

রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাত সন্তান ছিলেন, তিন ছেলে (কাসেম, আব্দুল্লাহ ও ইবরাহিম) এবং চার কন্যা (জয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা)। দুর্ভাগ্যবশত, পুত্ররা শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। পুত্র ও কন্যা সবার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল দৃষ্টান্তমূলক।

পুত্র ইবরাহিম রা:-এর প্রতি ভালোবাসা : হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত আছে- ইবরাহিম রা: যখন দুধমাতার কাছে থাকতেন, তখন নবীজি সা: শুধু তাকে দেখার জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেন, তাকে কোলে তুলে নিতেন এবং চুমু খেতেন। (মুসলিম-২৩১৬)। ইবরাহিম রা: শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় নবীজি সা:-এর হৃদয়ে গভীর বেদনা সৃষ্টি হয়। তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে একজন সাহাবি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটি হলো রহমত। এরপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই চক্ষু অশ্রু ঝরাচ্ছে এবং হৃদয় বিগলিত হচ্ছে। তবে আমরা মুখে কেবল তাই বলব, যা আমাদের রব পছন্দ করেন। তোমার বিরহে আমরা বড়ই ব্যথিত হে ইবরাহিম! (বুখারি-১৩০৩)। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সমর্পিত থাকা সত্ত্বেও একজন পিতার হৃদয়ে সন্তানের জন্য কত গভীর ভালোবাসা থাকতে পারে।

কন্যাদের প্রতি মমত্ববোধ : নবীজি সা: কন্যাদের প্রতিও সমান ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করতেন।

হজরত জয়নব রা: বদরের যুদ্ধে তার স্বামী আবুল আস ইবনে রবী বন্দী হলে জয়নব রা: তাকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ হিসেবে একটি হার পাঠান, যা তার মা খাদিজা রা: তাকে বিয়ের সময় দিয়েছিলেন। হারটি দেখে নবীজি সা:-এর মন এতটাই বিগলিত হয় যে, তিনি সাহাবিদের অনুরোধ করেন যেন আবুল আসকে মুক্তি দিয়ে হারটি ফিরিয়ে দেয়া হয়। সাহাবিরা সানন্দে তা করেন। (আবু দাউদ-২৬৯২)

হজরত রুকাইয়া রা: বদরের যুদ্ধের সময় রুকাইয়া রা: গুরুতর অসুস্থ হলে নবীজি সা: তার স্বামী উসমান রা:-কে যুদ্ধে না গিয়ে স্ত্রীর সেবা করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন যে, উসমান রা: যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও বদরের মুজাহিদের সমান সাওয়াব পাবেন।

উম্মে কুলসুম রা: : তৃতীয় কন্যা উম্মে কুলসুম রা: ইন্তেকালের পর নবী কমির সা: তার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকতেন। তাঁর চোখ থেকে তখন অবিরাম অশ্রু ঝরত। (বুখারি-১২৮৫)।

হজরত ফাতেমা রা: নবীজীর সা:-এর সবচেয়ে ছোট কন্যা ফাতেমা (রা:-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি ফাতেমাকে ‘দেহের অংশ’ বলে সম্বোধন করতেন এবং বলতেন, ফাতেমাকে যে কষ্ট দেয়, সে আমাকেই কষ্ট দেয়। যখন ফাতেমা রা: আসতেন, তিনি দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাতেন, তার হাত ধরে চুমু দিতেন এবং নিজের আসনে বসাতেন।

পার্থিবতার ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মিক শিক্ষা : রাসূলুল্লাহর সা: কাছে সন্তানদের জাগতিক আরাম-আয়েশের চেয়ে আখিরাতের কল্যাণ অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ফাতেমা রা:-এর জীবন। দারিদ্র্য এবং কষ্টের মাঝে তিনি জীবনযাপন করতেন। তিনি নিজ হাতে জাঁতা চালাতেন, রুটি তৈরি করতেন, পানি টানতেন এবং ঘর ঝাড়ু দিতেন। এতে তাঁর হাতে ফোসকা পড়তো এবং গায়ে দাগ বসে যেত। একবার নবীজি সা:-এর কাছে গণিমতের মাল এবং কিছু গোলাম এলে ফাতেমা রা: একজন খাদেমের জন্য আবেদন করেন।

একজন পিতার জন্য তার কন্যার এমন কষ্টের কথা শোনা কতটা বেদনাদায়ক হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু নবীজি সা: কী করলেন? তিনি তাদের ঘরে এসে শেখান যে, রাতে ঘুমানোর আগে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়া একজন খাদেমের চেয়ে উত্তম। এই শিক্ষা থেকে বোঝা যায়, নবীজি সা: তাঁর সন্তানদের আল্লাহর নৈকট্য লাভে উৎসাহিত করতেন, জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যে নয়। ফাতেমা রা: এই উপদেশ শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সন্তুষ্ট। (মুসলিম-২৭২৭)

রাসূলুল্লাহর সা: জীবন আমাদের জন্য একজন আদর্শ পিতার সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে। তাঁর পিতৃত্ব ছিল ভালোবাসা, ধৈর্য, নৈতিক শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিকতার এক অনুপম সমন্বয়। তিনি শিখিয়েছেন, একজন সফল পিতা তিনিই, যিনি শুধু সন্তানের দৈহিক প্রয়োজন মেটান না; বরং তাদের হৃদয় ও আত্মাকে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং আখিরাতের কল্যাণের দিকে পরিচালিত করেন। তাঁর আদর্শ মেনে চললে আমরা একটি সুশৃঙ্খল, নৈতিকতাপূর্ণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকারী পরিবার গড়ে তুলতে পারব ইনশাআল্লাহ।

লেখক : প্রভাষক, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জ