রুহুল আমিন সৌরভ কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
আওয়ামী দুঃশাসনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের তিন নেতাকর্মীকে হত্যা করে গুলিবিদ্ধ লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল শ্মশানঘাটে। হত্যার আগে একজনের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। তুলে নেয়া হয়েছিল হাত পায়ের নখ।
২০১৬ সালের পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে প্রাণ হারান তিন শিবির নেতাকর্মী। পুলিশ প্রকাশ্য দিবালোকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু বলেছিল কিভাবে তারা মারা গেছে পুলিশ তা জানে না। কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে গণ্য হলেও ফ্যাসিস হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার ও প্রশাসন বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে।
ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারের সাজানো গল্প বলে মামলাও করেছিল। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারের মামলা করার সাহস ছিল না এমন কি জিডিও নেইনি। কেউ কেউ আদালতে মামলা করার চেষ্টা করলে হয়রানি ও হুমকির শিকার হয়েছিল।
ফ্যসিস্ট সরকার বিদায়ের পর এসব হত্যার ঘটনায় পৃথক মামলা হয়েছে। তবে নেই কোনো অগ্রগতি। সম্প্রতি একটি মামলা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে।
কালীগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী নেতাদের ইন্ধনে তিন শিবির নেতাকর্মীকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে বিচার বহির্ভূত নির্মম হত্যার শিকার হয় কালীগঞ্জের মেধাবী তিন সন্তান। ১৮ মার্চ সাদা পোশাকে চারজন ব্যক্তি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে তুলে নিয়ে আবুজার গিফারীকে। পৌরসভার চাপালী গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে আবুজার গিফারী যশোর এম এম কলেজের বাংলা অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের পৌর শাখার সভাপতি। ঘটনার দিন নিজ গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজ শেষে বাড়ির পাশে আসলে দু’টি মোটর সাইকেলে চারজন ব্যক্তি গিফারীর পথরোধ করে। তার চিৎকারে বাড়ি থেকে গিফারীর মা বেরিয়ে এসে সন্তানকে জড়িয়ে ধরলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তারা নিজেদেরকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে গিফারীর হাতে হাতকড়া দিয়ে তুলে নিয়ে যায়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন আবুজার গিফারী মা কুলসুম বেগম, মামা ফজলু সরদার, ফুফু নূরজাহান বেগম, চাচাতো ভাই পান্নু রহমান, ফুফাতো ভাই রিপন হোসেন। এ ব্যাপারে গিফারীর পরিবার ২২ মার্চ কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করতে গেলে তা গ্রহণ করেনি থানা । এক সপ্তাহ পর ২৫ মার্চ বিকালে যশোর- ঝিনাইদহ মহাসড়ক সংলগ্ন সরকারি মাহতাব উদ্দীন ডিগ্রি কলেজের পাস থেকে মুখোশপরা সাদা পোশাকে অপরিচিত চারজন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয়ে শামীম মাহমুদকে তুলে নিয়ে যায়। শামীম কালীগঞ্জ পৌরসভা এলাকার বাকুলিয়া গ্রামের মাওলানা রুহুল আমিনের ছেলে এবং ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও শিবিরের পৌরশাখার কর্মী। এরপর পরিবার প্রশাসনের সব দফতরে খোঁজ করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি।
১৩ এপ্রিল সকালে যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের বহরামপুর সার্বজনীন শ্মশান ঘাট তাদের দু’জনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনার তিন দিন আগে ১০ এপ্রিল পৌরসভার ঈশ্বরবা গ্রামের জামতলা থেকে একটি ইজিবাইকে চারজন অপরিচিত লোক ছোটভাইয়ের সামনে থেকে মহিউদ্দিন সোহানকে তুলে নিয়ে যেতে দেখে স্থানীয়রা। অপরিচিত চারজনের মধ্যে কালীগঞ্জ থানার পুলিশ এসআই নীরবকে দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করে। সোহান ঈশ্বরবা গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী মহসিন আলীর ছেলে, কালীগঞ্জ শহরের শহীদ নুর আলী কলেজের প্রথম বর্ষের মানবিক বিভাগের ছাত্র এব শিবিরের কর্মী। সোহানের মা পারভিন আক্তার জানান, ওই দিন আমি ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। আমার জন্য দুই ছেলে জামতলা অপেক্ষা করছিল। ছেলেদের সাথে মোবাইলে কথা বলার ২০ মিনিট পর জামতলায় পৌঁছালে আমার ছোট ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বলল আম্মু ভাইকে কারা ধরে নিয়ে গেছে। এরপর ১১ এপ্রিল কালীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি, যার নং ৪৪৫। এরপর সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার, পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করলে তারা দুর্ব্যবহার করে এবং ঘটনা এড়িয়ে যায়। নিখোঁজ সন্তানের সন্ধান চেয়ে ১৭ এপ্রিল ঝিনাইদহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিল সোহানের পরিবার। ১০ দিন পর ২০ এপ্রিল সকালে চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার চন্দ্রতলা ব্রিজের নিচ থেকে চোখ উপড়ানো ও গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। বিচারের আশায় দীর্ঘ বছর ঘুরে গত ২৯ অক্টোবর ২৫ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে বলে জানান আইনজীবী জিল্লুর রহমান।
এতদিন দুঃশাসনের যাঁতাকলে বিচার না পাওয়ায় ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায়ের পর আবুজর গিফারী ও শামীম মাহমুদ হত্যার ঘটনায় পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞ আমলি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কালীগঞ্জ আদালতে আবুজার গিফারীর বাবা নুর ইসলাম বাদি হয়ে ১১ জন ও শামীম হোসেনের বাবা মাওলানা রুহুল আমিন বাদি হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেন। মামলাটি আমলে নিয়ে কালীগঞ্জ থানার ওসিকে এজাহারভুক্ত করতে নির্দেশ দেয় বিজ্ঞ আমলি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক রোমানা আফরোজ।
এ মামলার বিষয়ে বাদি পক্ষের আইনজীবী আব্দুর রশিদ বিশ্বাস বলেন, আবুজার গিফারী ও শামীম হোসেনকে হত্যার ঘটনায় পৃথক দু’টি মামলার আবেদন করেছিলেন নিহতদের বাবা। আদালতে ৩৬৪/৩০২/৩৪ দণ্ড বিধি আইনে মামলাটি করা হয়। আদালত ১৫৬(৩) ধারার বিধান মোতাবেক এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। বছর পেরিয়ে গেলেও মামলা দু’টির কোনো অগ্রগতি নেই। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে এমন আশঙ্কা এখন নিহতের পরিবারে। তবে কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, আদালতের নির্দেশ মোতাবেক মামলার বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সন্তানহারা পরিবারগুলো সঠিক বিচার পাবেন এমনটিই আশা করছেন পরিবার ও এলাকাবাসী।



