কৃষির ৫ সংস্থার ১২১৫ বিঘা জমি বেদখল

কৃষিজমি বেদখলে রাখার তালিকায় রয়েছে সরকারের অন্যান্য সংস্থার নামও। কয়েক হাজার কোটি টাকার বেদখল হওয়া এই সম্পত্তি উদ্ধারে বছরের পর বছর মামলা চলছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে।

কাওসার আজম
Printed Edition
  • সবচেয়ে বেশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ১০৪৫ বিঘা
  • আওয়ামী আমলে দখল যাত্রাবাড়ীর আড়াই শ’ কোটি টাকার সম্পদ

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৭টি দফতর ও সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বিএডিসিসহ পাঁচটি সংস্থার প্রায় এক হাজার ২১৫ বিঘা জমি বেদখল রয়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র যাত্রাবাড়ী, গাবতলী এবং রাজধানীর আশপাশের জেলাসহ সারা দেশে বিপুল পরিমাণ জমি বছরের পর বছর রাজনৈতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী, নানা প্রভাবশালী মহল দখলে রেখেছেন। কৃষিজমি বেদখলে রাখার তালিকায় রয়েছে সরকারের অন্যান্য সংস্থার নামও। কয়েক হাজার কোটি টাকার বেদখল হওয়া এই সম্পত্তি উদ্ধারে বছরের পর বছর মামলা চলছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে। জমি উদ্ধারে কৃষি মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলো দখলবাজদের বিরুদ্ধে যেমন মামলা করেছে তেমনি দখলবাজরাও সরকারি জমি দখলে রাখতে মামলা দিয়ে রেখেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত দফতর/সংস্থাগুলোতে বর্তমানে এক হাজার ৮১৯টি মামলা চলমান। যার বেশির ভাগই জমিজমা সংক্রান্ত বলে জানা যায়।

আওয়ামী আমলে দখল যাত্রাবাড়ীর আড়াই শ’ কোটি টাকার সম্পদ : খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেদখল হয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ১.৪৪ একর তথা প্রায় সাড়ে চার বিঘা জমি। যার বাজারমূল্য প্রায় আড়াই শ’ কোটি টাকা বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যাত্রাবাড়ী মৌজাস্থ ১.৪৪৭৬ একর জমি সিএস রেকর্ডীয় সূত্রে মালিক ছিলেন জনৈক কুলি বিবি গং। পরবর্তী সময়ে এসএ জরিপে সিএএস রেকর্ডীয় মালিকদের ওয়ারিশ হাবিবুর রহমান গংয়ের নামে রেকর্ডভুক্ত হয়। এই জমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) প্লান্ট প্রোটেকশন গোডাউন স্থাপন করার উদ্দেশ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ কেস (ভূমি অধিগ্রহণ) নম্বর ২৫/১৯৫৭-৫৮-এর মাধ্যমে ১.৩৪ একর (কম/বেশি) ভূমি অধিগ্রহণপূর্বক ডিএইর অনুকূলে হস্তান্তর হয়। ১৯৫৯ সালের ১২ মার্চ প্রকাশিত যার গেজেট নং ৩৮৫৯,পৃষ্ঠা নম্বর ২৩২। ডিএই এই জমির মালিকানা লাভের পর ভোগ দখল করে আসে। আরএস রেকর্ড হয় স্বাধীনতার পরে। আরএস জরিপে ২ নম্বর খতিয়ানে ১.৪৪৭৬ একর এই জমি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের নামে লিপিবদ্ধ হয়ে চূড়ান্তভাবে রেকর্ড প্রকাশিত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো বিগত আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা সিটি জরিপ চলাকালীন সময়ে প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভূমি জরিপ অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে সরকারি এই সম্পত্তি স্থানীয় একটি মহল নিজেদের নামে রেকর্ডভুক্ত করে নেয়। পরবর্তী সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এতে বাধা দেয়। কিন্তু প্রভাবশালী মহল এই জমিতে বহুতল ভবণ নির্মাণ করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। ২০১৩ সালে ডিএই ঢাকা সিটি জরিপ রেকর্ড সংশোধনের জন্য ৫২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিবাদি করে দেওয়ানি মামলা (৫৯১) দায়ের করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা যায়, ২০১১ সালে আব্দুল হাই নামের এক ব্যক্তি ডিএইর ১.৪৪৭৬ একর জমি থেকে ০.০৯৭৫ একর জমির মালিকানা দাবি করে দেওয়ানি মামলা (নং ১৮৮/২০১১) দায়ের করেন। পরবর্তী সময়ে আদালত পরিবর্তন হয়ে চতুর্থ যুগ্ম জেলা জজ আদালতের মামলা (নম্বর ৫০৮/২০২৩) দায়ের করা হয়। মামলাটি আগামী ৯ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য তারিখ রয়েছে। ২০১৩ সালে খোরশেদ আলম গং এই জমির আরো কিছু অংশ দাবি করে দেওয়ানি মামলা (নম্বর ৪৬৬/২০১৩) দায়ের করেন। পরবর্তী সময়ে আদালত পরিবর্তন হয়ে চতুর্থ অতিরিক্ত সহকারী জেলা জজ আদালতে মামলা (নং ৩৮২/২০২৪) দায়ের হয়। এই মামলাটি গত ২৯ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য ছিল; কিন্তু পরবর্তী তারিখ পাওয়া যায়নি। কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতর/সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, প্রতিপক্ষের ক্ষমতা ও অপকৌশলের কারণে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে। একই সাথে সরকার পক্ষের আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন না মর্মে অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। সরকারের মূল্যবান এই সম্পত্তি রক্ষায় মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অভিজ্ঞ বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগ দেয়া জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ১০৪৫ বিঘা জমি বেদখল : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) মোট জমির পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৮৭ একর তথা ৯ হাজার ৩৫৩ বিঘা। যাত্রাবাড়ীর ওই জমিটির মতো ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৩৪৪.৭২ একর তথা এক হাজার ৪৫ বিঘা জমি বেদখলে রয়েছে বর্তমানে। সাভারের সোবহানবাগ হর্টিকালচার সেন্টারের প্রায় ৪০ বিঘা জমির মধ্যে ১০ বিঘার বেশি জমি নিয়ে মামলা চলমান। দীর্ঘ দিন ধরে এই মামলা চললেও সুরাহা হচ্ছে না। আইনজীবী নিয়েও সমস্যায় রয়েছে ডিএই। ফলবীথি আসাদগেট হর্টিকালচার সেন্টারের অধীন জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে (আগারগাঁও) প্রায় ৭৫০টি মাতৃ গাছ রয়েছে। ডিএই সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে ২৯ অক্টোবর থেকে এই বাগানে কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এটি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে কথা হচ্ছে। এভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে বেদখল জমিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ৬৭৭টি মামলা চলমান রয়েছে।

বিএডিসির ১২৩ বিঘা জমি বেদখলে : কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত সংস্থা/দফতরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি)। সংস্থাটির ঢাকাসহ সারা দেশে ১০ হাজার ২৫২ একর তথা প্রায় ৩১ হাজার ৬৩ বিঘা জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৪০.৬২ একর তথা প্রায় ১২৩ বিঘা জমি বেদখলে রয়েছে। যেমন ঢাকার গাবতলীতে ২.২৫ একর তথা প্রায় পৌনে সাত বিঘা জমি গাবতলী আন্তঃজেলা বাসটার্মিনালের দখলে রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাথে এ নিয়ে নানা দেনদরবার চললেও জমি উদ্ধার করতে পারছে না বিএডিসি। জানা যায়, বেদখলীয় জমিসহ বিএডিসিতে বিভিন্ন কারণে ৭৮৯টি মামলা চলমান রয়েছে। সুনামগঞ্জে বিএডিসির জমির ৩০ শতক জায়গায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সেনবাগে বিএডিসির সারগুদাম ভেঙে তৈরি করা হয়েছে উপজেলা পরিষদের হলরুম। জমি দখলের পেছনে শুধু ব্যক্তি নয়, অনেকসময় সরকারই সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মোট ৭০৬ একর তথা দুই হাজার ১৪০ বিঘার মধ্যে প্রায় ২৮ বিঘা জমি বেদখলে রয়েছে। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রায় ১৮ বিঘা জমি বিএডিসি ভিত্তি পাটবীজ খামার ব্যবহার করছে। বগুড়ার শিবগঞ্জে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ৬ শতাংশ জমি পৌরসভার দখলে বলে জানা যায়। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির ১৬ শতাংশ জমি দখল করে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান মামলা দায়ের করে রেখেছে। এর বাইরে কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) কোনো জমি নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), কৃষি বিপণন অধিদফতর, মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমের (নাটা) কোনো জমি বেদখলে নেই বলে জানা যায়।

কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বেদখল হওয়া জমি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতর/সংস্থার পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দখলদাররাই কৃষির সংশ্লিষ্ট সংস্থা/দফতরের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে রেখেছে। দখলীয় কিছু জমিতে দখলদাররা স্থায়ী ভবন নির্মাণ করে বাস করছেন। কোথাও আবার মার্কেট করে ভাড়া কিংবা ব্যবসা করে খাচ্ছেন। অনেক জমির খতিয়ান ও নামজারিও হয়ে গেছে দখলদারের নামে। দখলীয় এসব জমির দাম কয়েক হাজার কোটি টাকা। বছরের পর বছর এসব জমি উদ্ধারে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বিভিন্ন সংস্থা/দফতরের এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়সারা গোছের চিঠি চালাচালি বা মামলায় কোনো মতে হাজিরার ব্যবস্থা করেই দায় সারছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দখলদারদের সাথে গোপন সমঝোতাতে গিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে, সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো দাবি করছে, অধিকাংশ জমি নিয়ে মামলা চলছে। দখলদাররা প্রভাবশালী। বেশি টাকা খরচ করে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নপথেও মামলার শুনানিতে প্রভাব তৈরি করে। তাই বেদখল জমিগুলো পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: ছাইফুল আলম বলেন, বেশির ভাগ জমি দখল হয়েছে অনেক আগেই। এখন মামলা চলছে। জমি উদ্ধারের বিষয়ে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি আইনজীবী নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জমি উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও বলা হয়েছে।

বিএডিসির চেয়ারম্যান মো: রুহুল আমিন খান বলেন, জমি ও গুদাম উদ্ধারে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি দফতরের জমির প্রতিবেদন প্রতি মাসে দিতে বলা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, জমিগুলোর দাম অনেক বেশি। তবে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন, তারা বদলি হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত মামলা পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটে। দখলদাররা যেমন জমি নিয়ে লেগে থাকেন, কর্মকর্তারা তা পারেন না।