দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায় বাংলাদেশে নির্ধারিত সফর ও ব্যবসায়িক বৈঠক বাতিল করছে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও গার্মেন্টস ক্রেতারা। খাত সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী দুই মৌসুমের অর্ডার বরাদ্দ ও কনফার্মেশনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বড় ক্রেতারা ঢাকা সফর স্থগিত বা বাতিল করায় কারখানাগুলোর উৎপাদন পরিকল্পনা ও বাজার প্রস্তুতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সাম্প্রতিক এক আলোচনা সভায় গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও সংশ্লিষ্ট শিল্পের নেতারা বলেন, নিয়মিত ব্যবসায়িক সফর, কারখানা পরিদর্শন এবং ফ্যাক্টরি কমপ্লায়েন্স অডিটের সময়সূচি পিছিয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। তারা সতর্ক করে বলেন, যেমনটা ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় দেখা গিয়েছিল, তেমনি পুনরায় দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কোচন দেখা দিলে গার্মেন্টস খাতে নতুন মৌসুমের ক্রয়াদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্র জানায়, গত তিন সপ্তাহে অন্তত ১৮টি বড় ব্র্যান্ডের মধ্যে একটি ইউরোপিয়ান রিটেইল জায়ান্ট, দুটি আমেরিকান ফ্যাশন চেইন এবং বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত স্পোর্টসওয়্যার ব্র্যান্ড ঢাকা সফর বাতিল করেছে। সাধারণত ক্রিসমাস, নতুন বছরের পরবর্তী মৌসুমের ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে এই সময়ে বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশে আসেন। তারা ফ্যাক্টরি পরিদর্শন, স্যাম্পল চেক এবং মূল্য নিয়ে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে নতুন মৌসুমের ক্রয়াদেশ ঠিক করেন।
একটি শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জানায়, তাদের চারটি প্রধান ক্রেতা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা আসার কথা ছিল। রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ায় তারা ইতোমধ্যে সফর স্থগিত করেছে। ক্রেতাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে আবার সময়সূচি নির্ধারণ করা হবে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশী রিটেইলাররা সাধারণত ‘রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সফরসূচি নির্ধারণ করে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যেসব আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরামর্শ জারি হয়েছে, এতে বাংলাদেশকে ‘হাই রিস্ক জোনে’ স্থান দেয়া হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর করপোরেট সেফটি টিম সফর বাতিলের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
একটি ইউরোপীয় ক্রেতা সংস্থার প্রতিনিধির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিজিএমইএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ আমাদের অন্যতম প্রধান সোর্সিং দেশ। কিন্তু আমরা কর্মীদের কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সফর স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
গার্মেন্ট শিল্পোদ্যোগীরা বলছেন, সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসগুলো পরবর্তী দুই মৌসুম গ্রীষ্ম এবং শীতের ক্রয়াদেশ সংগ্রহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশী ক্রেতারা এ সময় বাংলাদেশ সফর করে বড় পরিমাণ ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করেন।
এখন সফর বাতিল হওয়ায় কারখানাগুলো স্যাম্পল প্রেজেন্টেশন, পণ্যের আপডেট এবং গুণগত মান প্রদর্শনের সুযোগ হারাচ্ছে। এতে অর্ডার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হচ্ছে, অনেক ক্রেতা বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। একজন মাঝারি আকারের রফতানিকারক বলেন, তাদের দুই ক্রেতা সফর বাতিল করেছেন। তারা জানিয়েছেন, আলোচনা অনলাইনে চালানো যাবে, কিন্তু বড় পরিমাণ অর্ডার দিতে তারা সশরীরে অডিট করতে চান। এতে পরবর্তী মৌসুমের ক্রয়াদেশ পিছিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন।
পরিস্থিতির প্রভাবে শুধু ক্রয়াদেশই নয়, বরং নতুন বিনিয়োগের প্রবাহও কমার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বস্ত্র খাতে সম্প্রতি কয়েকটি বড় বিনিয়োগ প্রকল্পের ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ প্রক্রিয়া থমকে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এক বিনিয়োগকারী জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নতুন প্রকল্পে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে গেছে। বিদেশী অংশীদাররা পরিস্থিতি দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়বে।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ক্রেতাদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হলে তার প্রভাব শিল্পখাতে দীর্ঘমেয়াদে পড়বে। সরকারের প্রতি অনুরোধ, যেন দ্রুত স্থিতিশীল পরিস্থিতি নিশ্চিত করা হয় এবং বিদেশী ক্রেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে সুস্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র। আমরা যদি ক্রেতাদের সফর নিশ্চিত করতে না পারি, তারা সহজেই অন্য বাজারে চলে যাবে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সফর ও ক্রয়াদেশ স্থগিতের সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কারখানাগুলোতে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার’ বা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির কারণে তুলনামূলক নিরাপদ, সেখানে ছোট কারখানাগুলো মৌসুমি ক্রয়াদেশের ওপর বেশি নির্ভরশীল। ক্রয়াদেশ কমে গেলে এসব কারখানায় শ্রমিকদের ছুটি, ওভারটাইম কমে যাওয়া বা উৎপাদন কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। এতে শ্রমবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিজিএমইএ নেতারা বলেন, অনলাইন মিটিং ও ভার্চুয়াল অডিটে বড় অর্ডার দেয়া হয় না। বিশেষ করে নিরাপত্তা, কমপ্লায়েন্স ও পরিবেশগত মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতারা সশরীরে উপস্থিত থেকে নিশ্চিত হতে চান। তাই সশরীরে পরিদর্শন ছাড়া বড় পরিসরের অর্ডার বা দীর্ঘমেয়াদি সোর্সিং সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকার আশঙ্কা বাড়ছে।
বস্ত্র ও পোশাক শিল্প বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮৪ শতাংশ। শিল্পমহল মনে করে, রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব যদি আরো বিস্তৃত হয়, তবে চলতি অর্থবছরের রফতানি লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে। এ অবস্থায় শিল্পনেতারা সরকারের কাছে জরুরি ভিত্তিতে তিনটি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেগুলো হলো ক্রেতাদের জন্য নিরাপত্তা সুরক্ষা জোরদার করা। আন্তর্জাতিক সোর্সিং ব্র্যান্ডগুলোর সাথে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানো। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সঠিক বার্তা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে পৌঁছে দেয়া।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক রফতানি দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগী অবস্থানে রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা সেই অবস্থানকে দুর্বল করে দিতে পারে। ক্রেতাদের সফর স্থগিতের কারণে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে পরবর্তী দুই মৌসুমের ক্রয়াদেশের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং বিদেশী ক্রেতাদের নিরাপত্তা বিষয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে জরুরি।



