- পাচারকারী ফিলিপের তথ্য নেই গোয়েন্দাদের কাছে
- বিচারের দাবিতে ফের ফুঁসে উঠছে ইনকিলাব মঞ্চ
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদিকে হত্যার ঘটনায় প্রধান দুই সন্দেহভাজন শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল এবং আলমগীর হোসেনকে ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি ভারত থেকেও পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘটনায় দেশ-বিদেশে পরিকল্পিত হত্যা মিশনের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র।
হাদি হত্যার পর দিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ঘোষণা দেন, ফয়সাল করিম মাসুদকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। এর মধ্যেই গত শুক্রবার ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোস্ট ওয়ান্টেড ফয়সাল করিম মাসুদকে ধরিয়ে দিলে ২০ লাখ ভারতীয় রুপি পুরস্কারের ঘোষণা দেখা যায়।
ভারতীয় ভাষা, ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশিত একটি কার্ডে বলা হয়, ‘যে কোনো ভারতীয় নাগরিক যদি ফয়সাল করিম মাসুদকে জীবিত অবস্থায় ভারত থেকে বাংলাদেশে নিরাপদে স্থানান্তর করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে সক্ষম হন, তাকে ২০ লাখ রুপি পুরস্কার দেয়া হবে।’ যোগাযোগের জন্য ‘হাবিবুর রহমান’ নামে একটি ই-মেইল ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়।
এ দিকে হাদি হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচারের দাবিতে গত শুক্রবার রাতভর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ইনকিলাব মঞ্চ। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম ও তার সহযোগী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আলমগীর হোসেনকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। তারা ঘোষণা দেন, খুনিদের গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগের ইনকিলাব মঞ্চ চত্বরে অবস্থান অব্যাহত থাকবে। শীত উপেক্ষা করে সমর্থকেরা রাতভর সেখানে অবস্থান করেন। পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন- এমন খবরে সাময়িক বিরতি দেয়া হলেও দুপুরের পর ফের অবস্থান শুরু হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর ফয়সাল করিম ও আলমগীর হোসেনকে গ্রেফতার করতে না পারলেও তাদের পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর কারাগারে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ওসমান হাদিকে হত্যার পরিকল্পনা চলছিল। এই ‘কিলিং মিশন’ বাস্তবায়নে দেশী ও বিদেশী একাধিক পক্ষ যুক্ত ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্তে আরো উঠে এসেছে, হত্যাকাণ্ডের মূল সন্দেহভাজন শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ হত্যার আগে দেশের বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সাথে বৈঠক করেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ফয়সাল করিম গত ২১ জুলাই সিঙ্গাপুরে যান। সেখানে পৌঁছে তিনি সড়ক পথে মালয়েশিয়া সীমান্ত এলাকায় গিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সাথে বৈঠক করেন। ২৬ জুলাই দেশে ফেরার আগে এই পাঁচ দিনের মধ্যেই হত্যার ছক চূড়ান্ত করা হয়। সিঙ্গাপুর যাওয়ার সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফয়সাল নিজেকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, ফয়সালের ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট থেকে সিঙ্গাপুর ভ্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত এখনই বলা যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা গেছে, ফয়সাল হত্যার বিষয়ে স্ত্রী ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে ইঙ্গিত দিয়েছিল। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে সে স্ত্রীকে জানায়, সামনে এমন সময় আসতে পারে, যখন দেশে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা থাকার কথাও সে উল্লেখ করে।
ফয়সালের প্রেমিকা মারিয়া আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা জানান, হত্যার আগের রাতে সাভারের মধুমতি মডেল টাউনের একটি কটেজে ফয়সাল, আলমগীর ও মারিয়া অবস্থান করে। সে দিন ফয়সাল বলে, পরদিন এমন একটি ঘটনা ঘটবে, যা সারা দেশকে কাঁপিয়ে দেবে।
এ দিকে ফয়সাল ও আলমগীরকে ভারতে পালাতে সহায়তাকারী দুই ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাদের একজন যুবলীগ নেতার ভগ্নিপতি আমিনুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মিরপুরের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী (বাপ্পী) সীমান্ত পারাপারের মূল সমন্বয়কারী ছিলেন। ঘটনার রাতেই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে তারা ভারতে পালিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোডে শরিফ ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। পরে তার মরদেহ দেশে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির কাছে দাফন করা হয়।



