প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরও জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের সময় নিয়ে অচলাবস্থা কাটেনি। বরং এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব আরো বেড়েছে। নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হবে এমন ঘোষণা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির মন জয় করতে পারলেও জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট করার দাবিতে অনড় রয়েছেন। তারা মনে করছেন সরকার বিএনপির পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছে। এমনকি বিগত সময়ে ১/১১ এর পর যেভাবে একটি সাজানো নির্বাচনের ফল ঘোষণা করে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিলে একইভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এবার বিএনপিকে বিজয়ী করতে চাচ্ছে। সরকার কোনোমতে বিএনপির হাতে ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে চাচ্ছে বলেও মনে করে আন্দোলনরত আট দল।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া শুধুমাত্র উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ১০০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা নিজেই জুলাই সনদ লঙ্ঘন করেছেন। অবশ্য পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে দেয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ দিকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ৮ দলের নেতারা জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়ার ঘোষণায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এর বিরোধিতা করেছেন। পরে যৌথ বৈঠক করেও এর নিন্দা জানান তারা। শুক্রবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে গণভোট আলাদাভাবে দেয়ার দাবি জানানোর পাশাপাশি নেতারা অভিযোগ করেন- সরকার পক্ষপাতমূলক আচারণ করছে। সরকার বিএনপির দিকে ঝুঁকে রয়েছে জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ১/১১ এর পর যেভাবে সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো রকমে একটি নির্বাচন করে সাজানো পাতানো ফলাফল দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল এবারো সেভাবে বিএনপিকে বিজয়ী ঘোষণা করার পরিকল্পিত চেষ্টা চলছে। এমনকি তিনজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচারণের অভিযোগ এনেছেন তারা। উপদেষ্টারা বিএনপির সাথে গোপন বৈঠক করেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। আন্দোলনরত ৮ দলের নেতারা আজ ১৬ নভেম্বর বেলা ১১টায় একটি বৈঠক ডেকেছেন। ওই বৈঠক পর্যন্ত তাদের দাবি না মানলে যমুনার সামনে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচি শুরু করার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরও ওই কর্মসূচি থেকে সরে আসেনি ৮ দল। তাদের আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। তবে দলগুলোর নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কিছু বিষয় সমাধান হওয়ায় হয়তো যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি নাও থাকতে পারে, তবে গণভোট আগে হওয়ার দাবিতে তারা এখনো অনড় রয়েছেন। এ দাবিতে তারা আরো কর্মসূচি দিতে পারেন। অবশ্য বৈঠক থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে তারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির আল্লামা মামুনুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসাথে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সাথে গণভোট একত্রে অনুষ্ঠিত হলে জনগণের মনোযোগ বিভ্রান্ত হবে। গণভোটের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো মানুষ যথাযথভাবে বুঝে মত প্রকাশ করতে পারবে না। এতে গণভোটের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিঘিœত হবে। তিনি আরো বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকার যদি জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও স্বতন্ত্র গণভোটের গণদাবি পূরণ না করে তবে সেটি হবে আমাদের জন্য হতাশাজনক এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আদর্শ ও স্বীকৃতিকে ঝুঁকিতে ফেলার দুঃখজনক পদক্ষেপ। এ জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বতন্ত্র দিনে গণভোট আয়োজন করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী নয়া দিগন্তকে বলেন, গণভোট জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হলে গণভোট গুরুত্বহীণ হয়ে যাবে। এ জন্য আমরা আগে গণভোটের দাবি জানিয়েছি। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান আগের মতোই রয়েছে।
এ দিকে গণভোট হলে তাতেই সংবিধান সংশোধন হবে না বলে মত প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বলেন, মনে রাখতে হবে, গণভোটের মধ্য দিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়ে যাবে না। গণভোটের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে না। এর জন্য আগে অবশ্যই জাতীয় সংসদ গঠিত হতে হবে। জুলাই সনদে দলগুলো স্বাক্ষরের পর যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে সেগুলোরও দায় নেবে না বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ যেভাবে সই হয়েছে, তা প্রতিপালনে বিএনপি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এর বাইরে চাপিয়ে দেয়া, জবরদস্তিমূলক কোনো প্রস্তাব যদি দেয়া হয়, তা জনগণ বিবেচনা করবে। এটা জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন বলেও মনে করে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবে ক্ষুণœ হোক তা আমরা চাই না। সে জন্য কোনো আরোপিত আইন দিয়ে, আদেশ দিয়ে, জবরদস্তিমূলক প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ আমরা করতে দেবো না।



