টিকটকে মারাত্মক আসক্ত তরুণ-তরুণীরা

এসব ভিডিওতে শুধু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যই নীতিনৈতিকতার খোলস ছেড়ে বেপরোয়া নাচ-গান তৈরি করা হয়। বিশেষ করে অল্প বয়সী শিক্ষার্থী বা কিশোর-কিশোরীরা অধিক ভিউ, শেয়ার বা কমেন্টের আশায় নাচ-গানের ভিডিও অহরহ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

মনিরুল ইসলাম রোহান
Printed Edition
  • সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক নগ্নতা ও অশ্লীলতা
  • সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে বেপরোয়া নাচ-গানের শর্ট ভিডিওর ছড়াছড়ি
  • কোমলমতি শিশুদের পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম

বিশ্বব্যাপী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করার জনপ্রিয় শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটক অ্যাপ। নাচ, কৌতুক এবং শিক্ষাসহ নানা বিষয়ের ওপর তিন থেকে ৬০ সেকেন্ড পর্যন্ত সময়সীমার বিভিন্ন ধরনের ছোট ভিডিও তৈরি করার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে টিকটক এদেশেও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তবে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক এ মাধ্যমটিতে মারাত্মক আসক্ত হয়ে পড়ে দেশের যুবসমাজ বিপথে চলে যাচ্ছে। এসব ভিডিওতে শুধু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যই নীতিনৈতিকতার খোলস ছেড়ে বেপরোয়া নাচ-গান তৈরি করা হয়। বিশেষ করে অল্প বয়সী শিক্ষার্থী বা কিশোর-কিশোরীরা অধিক ভিউ, শেয়ার বা কমেন্টের আশায় নাচ-গানের ভিডিও অহরহ ছড়িয়ে দিচ্ছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে পরিবার ও সমাজে। সমাজের প্রতিটি গোড়ায় জেঁকে বসে আছে এ বিষাক্ত জাল। ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবাও ধর্মীয় সবখানেই এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি অশ্লীল ভিডিও কনটেন্ট প্রচারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে ইন্টারনেটের আপত্তিকর আসক্তির দিকে ঠেলে দেয়ার তীব্র অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে অভিভাবক ও সমাজ বিশ্লেষকদের মধ্যে।

অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে গিয়েও টিকটক করছে। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে নির্জন কোনো এলাকায় বা নদীর পাড়ে গিয়ে নাচ গানের ভিডিও করে টিকটকে ছেড়ে দিচ্ছে। এটা করতে গিয়ে সেখানেও ঘটছে নানা অঘটন। এসবে আসক্ত ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার পরিবর্তে টিকটকে বেশি সময় দিচ্ছে। ফলে মারাত্মকভাবে পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। অভিভাবকরা বলছেন, ছেলেমেয়েরা বাসায় থেকেও টিকটকের প্রতি মারাত্মক আসক্ত হয়ে পড়েছে। একটার পর একটা নানান ধরনের শর্ট ভিডিও দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করছে। ছেলেমেয়েরা ক্লাসেও মনোযোগী নয়, বাসায় থাকলেও মনোযোগ টিকটকে।

সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে টিকটকের নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বেড়েছে। টিকটকের প্রভাবে নানা গান ও সংলাপের সাথে তরুণ-তরুণীরা ঠোঁট মেলাচ্ছেন, অদ্ভুত সব নাচের মুদ্রা রপ্ত করছেন। স্বল্প সময়ে তারকাখ্যাতি অথবা দ্রুত নিজেকে ভাইরাল করতে গিয়ে উচ্ছৃঙ্খলতার পথ বেছে নিচ্ছেন। তাদের মতে, এ অ্যাপের মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক, নগ্নতা ও অশ্লীলতার মতো ভয়াবহ দিকগুলো। আর এ কারণে বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হচ্ছে টিকটক। শুধু নিষিদ্ধ নয়, এই সস্তা বিনোদনের প্লাটফর্মটির বিরুদ্ধে অনেক দেশ মামলাও করেছে। তারপরও কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় তোয়াক্কা না করে আপন মনে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, টিকটকে অশ্লীল শর্ট ভিডিও ছেড়ে এক শ্রেণীর মানুষ ভিউ ব্যবসা করছে। এর মাধ্যমে বড় ধরনের আয়ও করছে একশ্রেণীর মানুষ। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এদেশের তরুণ প্রজন্ম। অধিক ভিউয়ের আশায় এবং সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে নানা ঢংয়ে শর্ট ভিডিও আপলোড করছে টিকটক ব্যবহারকারীরা। এক সময় পরিবার ও সমাজের নীতিনৈতিকতার খোলস ছাপিয়ে ছোট কাপড় পরিধান করে শর্ট ভিডিও টিকটকে ছেড়ে দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছে। এগুলো দেখে অনেকেই ওইসব নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। দেখা যায়, এসবের প্রতি আসক্ত হয়ে ঘর-সংসারও ভেঙে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. রবিউল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, টিকটক এখন আমাদের দেশের জন্য একটি বার্নিং ইস্যু। সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে যেমন সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে, বিভিন্ন মুভমেন্টের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে তেমনিভাবে নেতিবাচক দিকগুলোও অনেক বেশি। ফলে এগুলোর আড়ালে ইতিবাচক দিকগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। টিকটকের কারণে অনেকের পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, অনেকেই আত্মহত্যা করছে। সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয় এমন উপাদান এ মাধ্যমে প্রসার ঘটছে। টিকটকে আসক্ত হয়ে পড়েছে ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরা। ষাটোর্ধ্ব বয়সীরা এগুলোতে তেমন আসক্ত না হলেও বিশেষ করে ১৫ বছর থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ্বরা টিকটকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ড. রবিউল ইসলাম মনে করেন, সরকারের পক্ষ থেকে এটা এখনই নিয়ন্ত্রণ করার সময় এসেছে। এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের সমাজের সামনে আরো বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোস্তফা হাসান মনে করেন, তরুণ প্রজন্মকে ভর করে এগুলো এগোচ্ছে। পরিবারের বড়রা নানান কারণে ব্যস্ত থাকেন। আগে আমরা আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে যেতাম, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম, খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতাম এখন আর এগুলো তেমন দেখা যায় না। তরুণরা আকৃষ্ট হয় এমন কোনো বিনোদন আমরা দিতে পারছি না। ফলে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে ছেলেমেয়েরা। তারা এখন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে টিকটককে বেছে নিয়েছে। তারা টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনোদন খুঁজে। পাশাপাশি একশ্রেণীর মানুষ আছে এটাকে ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে। এটা মূলত সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে হচ্ছে। নাচ, গান, অশ্লীল ভিডিও দেখে তারা সময় নষ্ট করছে।

ড. মোস্তফা হাসানের মতে, টিকটক হয়তো একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তা ছাড়া সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সচেতন হওয়া দরকার। টিকটকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে গোলটেবিল আলোচনা, সেমিনারের মতো বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা, যেন সবাই সচেতন হতে পারে।

টিকটক ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে দাউয়ান উড়ুঁরহ নামে চীনে প্রথম চালু হয়। পরে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিকভাবে টিকটক নামে পুনরায় চালু হয়। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে টিকটকের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালের মধ্যে এটি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মকে ছাড়িয়ে যায়। যদিও কিছু সময়ের জন্য বাংলাদেশে টিকটকের কিছু কনটেন্ট ফিল্টার করা হয়েছিল, তবে পরে আবার তা চালু করা হয়।