দীর্ঘদিন প্রায় ১৬ বছর পর কৃষিবিদদের সংগঠন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (কেআইবি) নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে ভোটবঞ্চিত থাকা কেআইবি এবার নির্বাচনের পথে ফিরছে। দীর্ঘদিনের আর্থিক অনিয়ম, রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরে প্রশাসকের উদ্যোগে ৩৩ হাজার সদস্যের এই সংগঠনে গতি ফিরেছে। ইতোমধ্যে গঠন হয়েছে নতুন নির্বাচন কমিশন। ভোটকে কেন্দ্র করে সাধারণ কৃষিবিদদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিহীন এই নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কৃষিবিদদের আলাদা নির্বাচনী প্যানেল হতে পারে। এর বাইরে স্বতন্ত্রভাবেও প্যানেল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নির্বাচনের এখনো তফসিল ঘোষণা না হলেও আগামী জানুয়ারির মধ্যেই এই নির্বাচন হতে পারে বলে জানা গেছে।
কেআইবিতে প্রতি দুই বছর পরপর নির্বাচন হওয়ার কথা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর সর্বশেষ ২০০৯ সালে কেআইবিতে ভোট উৎসব হয়েছিল। এতে কৃষিবিদ ওয়াসিউজ্জামান আকন্দ সভাপতি ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মহাসচিব নির্বাচিত হন। এরপরের বার কৃষিবিদ ড. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ সভাপতি ও বাহাউদ্দিন নাছিম মহাসচিব হন। পরের বার ২০১৪ সালে বাহাউদ্দিন নাছিম সভাপতি ও মোহাম্মদ মোবারক আলী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহাসচিব নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কৃষিবিদ এ এম এম সালেহ সভাপতি ও কৃষিবিদ খায়রুল আলম প্রিন্স মহাসচিব হন। ২০১৭-১৮ মেয়াদের এই কমিটি দিয়ে শেখ হাসিনা পতনের দিন পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে কেআইবির কার্যক্রম। গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কেআইবিতে পরিচালনা পরিষদ না থাকলেও বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা তা দখলে নেন।
অ্যাবের সাবেক আহ্বায়ক রাশিদুল হাসান হারুন ও বিএনপির গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীমসহ আরো একাধিক গ্রুপ, উপগ্রুপ স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়ায়। আগের মতোই কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দেখা দেয় দলাদলি। হলরুম ভাড়া ও খাবারের টাকার ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্ব নিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি বিএনপিপন্থী দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন। এমন পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় গত ২০ জানুয়ারি লে. কর্নেল মো: আব্দুর রব খানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। দায়িত্ব নিয়েই তিনি শুদ্ধি অভিযানে নামেন।
রাজধানীর খামারবাড়ি সড়কের কেআইবির প্রধান কার্যালয়ের হলরুম ভাড়া, ডরমিটরি, জিমনেসিয়াম, সুইমিং পুল, ক্যাফেটেরিয়া এবং সদস্যদের চাঁদা থেকে মাসে এক কোটি টাকারও বেশি আয় হয়। তবে এসব খাতের বড় অংশের অর্থ কখনো সংগঠনের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি। অর্থ লুটপাট, ভুয়া বিল-ভাউচার ও আত্মসাতের অভিযোগে কেআইবি কর্তৃপক্ষ এখন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি থানায় একাধিক মামলা ও সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। শুদ্ধি অভিযানে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘদিনের আর্থিক অনিয়ম, ভুয়া খরচের চালান, প্রকল্প অর্থ আত্মসাৎসহ নানা দুর্নীতির তথ্য। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও মহিলা শ্রমিক লীগের অন্তত ২০টি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় কেআইবির মিলনায়তনে। এসব অনুষ্ঠানের ভাড়া ৯৭ লাখ টাকা হলেও এর এক টাকাও সংগঠনের তহবিলে জমা হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভাড়াও আত্মসাৎ হয়েছে। খাবার সরবরাহ ও সাজসজ্জার কাজেও ছিল একচেটিয়া দখল। নিয়ম অনুযায়ী, একাধিক প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে সব কাজ দেয়া হয় ‘ইকবাল ক্যাটারিং’কে। প্রতিষ্ঠানটি কেআইবির একটি কক্ষ অফিস হিসেবে ভাড়া নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, দুই বছর পরপর ভাড়া ১০ শতাংশ বাড়ানোর কথা। সেই অনুযায়ী, বকেয়া ভাড়া বাবদ চার লাখ ৮৬ হাজার ৭৬৪ টাকা ইতোমধ্যে আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য খাতের ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে।
নানা অনিয়মের অভিযোগে গত ৩০ আগস্ট তেজগাঁও থানায় কেআইবির সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) মো: ছানোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি অবসরে যাওয়ার পর অফিসের গুরুত্বপূর্ণ নথি গোপনে সরানোর চেষ্টা করেন। প্রহরীর হাতে ধরা পড়ে তার ব্যাগ থেকে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের আটটি বুকিং রেজিস্টার জব্দ করা হয়, যা চলমান নিরীক্ষার অংশ ছিল। এ ছাড়া গত ৮ অক্টোবর একই থানায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কেআইবির হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো: জুলফিকার আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় বলা হয়, তিনি ২০১৯ ও ২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ৬০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওই টাকা ব্যক্তিগত ও সহকর্মীর নামে তিনি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে পরে সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করে টাকা তুলে নেন। এ ছাড়া লুটপাটের প্রমাণ আড়াল করতে তিনি অফিসের কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক সরিয়ে ফেলেন। এসব অভিযোগে জুলফিকার আলীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি ও ব্যক্তিগত আপ্যায়নের খরচও দেখানো হয়েছে কেআইবির তহবিল থেকে। আট মাসে আপ্যায়ন খরচ তুলে নেয়া হয় দুই লাখ টাকা।
জানা যায়, ২০১৭-১৮ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কয়েকবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে, আওয়ামীপন্থী কৃষিবিদদের দু’টি গ্রুপ সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম গ্রুপের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বে তা আর হয়ে ওঠেনি। নির্বাচন নিয়ে সঙ্ঘাত এবং তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর কার্যনির্বাহী কমিটি বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সমাজসেবা অধিদফতর। সে সময় আওয়ামীপন্থী কৃষিবিদরা কেআইবির দখল ছাড়েননি। তারা প্রশাসককে কেআইবিতেই ঢুকতে দেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপিপন্থী কৃষিবিদরা কেআইবির দখল নেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামীপন্থী কৃষিবিদরা একচেটিয়া নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে সর্বশেষ যে নির্বাচন হয় এতে বিএনপি, জামায়াতপন্থীরা অংশই নেয়নি। এর আগে অপর দু’টি নির্বাচনে অংশ নেয়ার চেষ্টা করলেও মূলত আওয়ামী আধিপত্যের কারণে টিকতে পারেননি বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা।
গত ২০ জানুয়ারি লে. কর্নেল মো: আব্দুর রব খান প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বলেন, নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিশন একটি সুষ্ঠু ভোট উপহার দেবেন বলে বিশ^াস। ।
জানা যায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর গঠিত নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. লুৎফুর রহমান। বাকি সদস্যরা হলেন- বিএডিসির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মাহমুদ হোসাইন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো: তারিক হাসান, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক পরিচালক মো: আব্দুল বাতেন, সেনাবাহিনী সদর দফতরের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (কৃষিবিদ) ড. সাইফুল্লাহ আনসারি, সাবেক সচিব ড. মো: আফজাল হোসেন, মৎস্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ড. মো: আবুল হাছানাত ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরীফ আহমেদ চৌধুরী।



