রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা সাশ্রয়ী উপায়ে দেয়ার পাশাপাশি জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের এনজিওগুলোকে এ ধরনের কাজে আরো অধিক উপায়ে কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়েছেন বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী। এটি করা সম্ভব না হলে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে সরকারের বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ বাড়বে এবং সহায়তা আরো ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। একই সাথে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও বস্ত্র সহায়তার জন্য আমদানিকৃত পণ্যের পরিবর্তে দেশী পণ্য ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিতে গিয়ে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে ২৬৩ শতাংশ বেশি। অথচ ১১ লাখ ৫৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার জন্য বিদেশী সহায়তা কমে যাওয়ায় এটি এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে যার প্রভাব বাংলাদেশকে সহ্য করতে হচ্ছে।
নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন রেজাউল করিম চৌধুরী।
নয়া দিগন্ত : রোহিঙ্গা কর্মসূচির সাশ্রয়ী বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব?
রেজাউল : রোহিঙ্গাদের সহায়তা কার্যক্রম কক্সবাজার থেকে পরিচালনা করতে হয় বলে ক্যাম্পে যেতে-আসতে সময় লাগে চার ঘণ্টা, রোহিঙ্গা রেসপন্সের সমস্ত স্টাফরা যদি উখিয়ায় থাকে তাহলে সময় ও অর্থ দুই বেচে যায়। ইউএন বা বিদেশী এনজিওদের রোহিঙ্গা সহায়তা কার্যক্রমে ওভারহেড খরচ ও স্যালারি কস্ট বেশি। স্থানীয় ছেলেমেয়েকে এ ধরনের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা গেলে তুলনামূলকভাবে অনেক খরচ কমে যাবে। বিদেশী জনবলকে ১০ লাখ, ২০ লাখ, ৫ লাখ টাকা বেতন দিতে হচ্ছে, কক্সবাজারে তারা বিলাসবহুল হোটেলে থাকেন অথচ স্থানীয় তরুণদের ৫০-৬০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে এ ধরনের কাজ করা যায়। কক্সবাজার, উখিয়া বা ঢাকার ছেলেমেয়ে কম টাকায় জীবন নির্বাহ করতে পারে। এজন্য দেশী এনজিওগুলোকে রোহিঙ্গা সহায়তা কার্যক্রমে বেশি কাজে লাগানোর কথা বলছি। ভাষাগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের তরুণরা রোহিঙ্গাদের সাথে অনেক ফ্যামিলিয়ার হয়ে কাজ করতে পারবে। একজন বিদেশী গেলে ইন্টারপ্রেটার লাগে, আমাদের তা লাগে না। রোহিঙ্গাদের জন্য শুঁটকি মাছ থাইল্যান্ড থেকে আমদানির দরকার নেই, জাপান থেকে লবণ আনার দরকার নেই, রোহিঙ্গারা থামি পড়তে পছন্দ করে, এখানে সিরাজগঞ্জের লুঙ্গি ব্যবহার করা যায়। কক্সবাজারের শুঁটকি ও লবণ ব্যবহার করতে পারি। ব্যয় সঙ্কোচনের সাথে সাথে স্থানীয় শিল্পকে এভাবে উৎসাহিত করা যায়।
নয়া দিগন্ত : কক্সবাজারে ইউএন বা বিদেশী এনজিওগুলোর অফিস পরিচালনা খরচও তো বেশি।
রেজাউল : কক্সবাজারে ইউএন অফিসগুলো মেইনটেইন করার কোনো প্রয়োজন নেই। কক্সবাজারে সারাদিন ১২টা থেকে ১৬টা মানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ফ্লাইট চলে। অফিসগুলো উখিয়ায় নিলে কক্সবাজার শহরের ওপর চাপ কমে। ছোট পর্যটন শহরটিতে যানজট লেগে থাকছে, ইউএন’র গাড়িগুলো রাখার জায়গা না থাকায় কক্সবাজার স্টেডিয়ামের পাশে, রাস্তায় গাড়ি রেখে দেয়। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে এ ধরনের শরণার্থী ক্যাম্প পরিচালনার সাথে কক্সবাজারে থেকে ক্যাম্প পরিচালনার পার্থক্য রয়েছে। কক্সবাজারে ফাইভ স্টার হোটেল আছে, ১০ থেকে ১২টা। এটাতো একটা রিফিউজি ট্যুরিজম। এটাতো রিফিউজি অপারেশন না। এই সিনড্রোমগুলো কমিয়ে আনা যায়। ঢাকায় থেকে কক্সবাজারে গিয়ে বিকেলে চলে আসা যায়।
নয়া দিগন্ত : রোহিঙ্গা সহায়তার বেশির ভাগ কি তাহলে পরিচালন ব্যয় হচ্ছে?
রেজাউল : সিরিয়াস সাইন্টিফিক স্টাডি করে দেখেছি- প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার প্রতি মাসে সহায়তা থেকে পায় ৭০ থেকে ৯১ ডলার। অথচ প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের (পাঁচ থেকে ছয় সদস্য) জন্য মাসে বরাদ্দ আসে ৩৫০ ডলার। এই ৩৫০ ডলার হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য মোট সহায়তাকে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে পাওয়া। যা এ বছর এসেছে। বাকি টাকাটা যায় কোথায়? রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে গিয়ে স্টাডি করেছি তার ঘরে কী কী রিলিফ সামগ্রী আছে, সবটির দাম কত, অন টপ অব দ্যাট প্রতি মাসে সে বারো ডলার করে ফুড রেশন পায়। এই ফুড রেশন অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : আপনাদের প্রস্তাবনাগুলো কী কী?
রেজাউল : রোহিঙ্গাদের শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ওমেন প্রটেকশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অর্থ সহায়তা কমে যাচ্ছে। তাই অনেক আগে থেকে আমরা এ ধরনের বিভিন্ন সাশ্রয়ী প্রকল্প নেয়ার কথা বলে আসছি। কিন্তু ইউএন বলছে না যে তারা ব্যয় কমানোর জন্য কোনো বিকল্প বা পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা কম বেতনে স্থানীয় ছেলেমেয়েকে কক্সবাজারে ইউএন অফিসে নিয়োগ দেয়ার কথা বলেছি। রোহিঙ্গাদের সহায়তা কার্যক্রমের ৪.৮ শতাংশ ব্যয় করে স্থানীয় এনজিওগুলো। স্থানীয় এনজিওগুলোর মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়ন করে না। প্রকল্পের ৩৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করে জাতীয় এনজিওগুলো। ব্র্যাকের কস্ট খুব বেশি। ব্র্যাক চার ভাগের এক ভাগ তহবিল ম্যানেজ করে। স্থানীয় এনজিওগুলোর মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে খরচ অনেক কমে যেত।
নয়া দিগন্ত : রোহিঙ্গাদের প্রকল্পে খরচ কমাতে না পারলে এই ব্যয়ভার মেটাতে গিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে...
রেজাউল : সরকারকে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এই চাপ আরো বাড়বে। গত বছর টোটাল অপারেশনের ১১ শতাংশ সরকার ব্যয় করেছে, এ বছর কিন্তু সেই ব্যয় ৩৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ২৬৩ শতাংশ রোহিঙ্গা মানবিক ব্যয় বেড়েছে সরকারের। ইউএন এজেন্সিকে অনুদান দেয়া হচ্ছে অথচ একই কাজে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। যেটা শোধ করতে হবে জনগণের টাকা থেকে।
নয়া দিগন্ত : রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান বা উৎপাদনের সাথে জড়িত করা যায় কিভাবে?
রেজাউল : ইনকাম জেনারেটিং স্কিলড ট্রেনিং দিতে হবে। ইউএন এ কাজে সহায়তা করলে ডিপেন্ডেসিটা কমে যাবে। এটা না হলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাবে। সরকারের যুক্তি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের কাজ করতে দিলে স্থানীয়রা কাজ পাবে না। এটা সত্যি কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সারা দেশে একজন দিনমজুরের প্রতিদিনের পারিশ্রমিক ৬০০ টাকা হলেও কক্সবাজারে সেটা ৩০০ থেকে ২০০ টাকা। রোহিঙ্গারা বাজারে ঢুকে গেছে। বন্ধ করে রাখা যায়নি। তৎকালীন সরকার ভাসানচরে তাদের থাকার ব্যবস্থা কেন করেছে গড নোজ। ওআইসিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নিয়েই রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করলে তারা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : অন্য দিকে রোহিঙ্গা সহায়তা কমতে শুরু করেছে।
রেজাউল : সবচেয়ে নাটকীয় হ্রাস এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকে, যারা তাদের তহবিল ৭২% কমিয়েছে। যুক্তরাজ্য কমিয়েছে ৪৮%। জাতিসঙ্ঘের হিসেবে গত বছর রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় ৮৫২.৪ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০১ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যা একই বছর বিদেশী দাতাদের দেয়া মোট ৫৪৮.৯ মিলিয়ন ডলারের ৫৫ শতাংশ। ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত মাত্র ৩৮% তহবিলের প্রয়োজন পূরণ হয়েছে। এটি একটি ‘গুরুতর আর্থিক সঙ্কট’ নির্দেশ করে। অথচ রোহিঙ্গাদের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপনা ব্যয় প্রায় ৭০% যেখানে কর্মসূচি ব্যয় মাত্র ৩০%। স্থানীয় বেশির ভাগ এনজিও তাদের তহবিল হারিয়েছে এবং এখন প্রায় ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে কিন্তু তাদের ব্যবস্থাপনা ব্যয় কম। গত তিন মাসে রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক প্রকল্পের জন্য মোট ৫১৯ মিলিয়ন বাংলাদেশী টাকা অনুমোদিত হয়েছে। তহবিলের বেশির ভাগ অংশ আন্তর্জাতিক এনজিওগুলির। আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর আধিপত্য ৪৪.৪%, প্রকল্পে ৬৩.৬% তহবিল। জাতীয় এনজিও : প্রকল্প ৫০.৮% কিন্তু তহবিল ৩৩.৯%, স্থানীয় এনজিও : তীব্রভাবে তহবিলহীন, প্রকল্প ৪.৮% কিন্তু তহবিল মাত্র ২.৫%।
নয়া দিগন্ত : জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সহায়তা প্রকল্প টিকিয়ে রাখতে কী করা যেতে পারে?
রেজাউল : রোহিঙ্গা সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা জরুরি। জাতিসঙ্ঘের সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক এনজিওদের সরাসরি বাস্তবায়নের সুযোগ প্রায় নেই। স্থানীয় এনজিওগুলোকে কমপক্ষে ৫০% সরাসরি তহবিল দেয়া প্রয়োজন। ব্যবস্থাপনা ব্যয় হ্রাস করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তহবিল ব্যবস্থার জন্য একটি বিস্তৃত ড্যাশবোর্ড প্রয়োজন। তহবিল ব্যবহারে স্থানীয় এনজিওগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করা এবং ব্যবস্থাপনায় কোনো মধ্যস্থতাকারী থাকা উচিত নয়।