শেখ পরিবার এস আলমসহ ১১ ব্যক্তির ৫৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন রেহেনাসহ শেখ পরিবার এবং এস আলম, সামিটসহ ১০ প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থপাচার করার অভিযোগে ৫৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার দেশী ও বিদেশী সম্পদ জব্দ করেছেন আদালত। এর মধ্যে ৪৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা দেশীয় সম্পদ এবং বিদেশী ১০ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। বিদেশী সম্পদের মধ্যে যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও বেক্সিমকো গ্রুপের ২৬ কোটি পাউন্ড জব্দ করেছে সেদেশের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। যুক্তরাজ্যে জব্দকৃত এ অর্থের পরিমাণ দেশীয় মুদ্রায় চার হাজার ২৬৪ কোটি টাকা (প্রতি পাউন্ড ১৬৪ টাকা হিসেবে)। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সাথে পালিয়ে যান দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রী, এমপি, দলীয় শীর্ষ নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীরা। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই দুর্নীতির চিত্র বের করার নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বয়ে গঠিত টিম পাচারকৃত অর্থের সন্ধানে নামে। প্রথমে পতিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, বোন রেহেনাসহ শেখ পরিবার ও শীর্ষ পাচারকারী ১০টি প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারের চিত্র অগ্রাধিকারভিত্তিতে তদন্তের আওতায় আনা হয়। তাদের তদন্তে হাজার হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য বের হতে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে অর্থপাচার অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংকে জনগণের আমানতের অর্থ ছিল লুটেরাদের প্রধান টার্গেট। জনগণের আমানতের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য এস আলম নামক এক অখ্যাত মাফিয়া প্রতিষ্ঠানের কাছে দেশের প্রতিষ্ঠিত আটটি ব্যাংকের মালিকানা ছেড়ে দেয়া হয়। রাতের অন্ধকারে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে ব্যাংকের মালিকানা হাতিয়ে নেয় এস আলম। এ কাজে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। মিলেমিশে জনগণের আমানতের অর্থ ভাগবাটোয়া করে নেয়ার জন্য আটটি ব্যাংক ও আরো কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দেয়া হয় মাফিয়া এস আলমকে। এরপর থেকেই পানির মতো ব্যাংকগুলো থেকে টাকা বের করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক এক হিসেবে শুধু এস আলমই ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে নামে বেনামে বের করে নেয় দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, যার বেশির ভাগই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এস আলমের পাশাপাশি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ডজন খানেক দেশে অর্থপাচারের সন্ধান পাওয়া যায়। এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে দেশের ভেতরে ও বাইরে বিপুল সম্পদ রয়েছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, তাঁদের নামে ১২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬৩৫ কোটি টাকার অস্তিত্ব। এর পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাজউকের প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি জব্দ করা হয়েছে। বিশেষ করে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৬০ কাঠা প্লট এবং প্রায় আট কোটি ৮৫ লাখ টাকার জমি ও ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্ত অনুযায়ী, শেখ হাসিনা পরিবারের সম্পদ শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে বিপুল অর্থ ও সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাশিয়া থেকে আসা অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ-সংক্রান্ত দুটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ জমা দেয়া হয়েছে।

সরকারি যৌথ তদন্তে জানা গেছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদ এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে সাতটি এবং যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পদের বিপরীতে এনবিআর অন্তত ১১টি কর ফাঁকির মামলার তদন্ত করছে। এছাড়া ৩৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ১০২ কোটি টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে ৩৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় পাঁচ কোটি ২৭ লাখ টাকা জমা আছে। এসব অর্থ জব্দ করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্টদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

সর্বশেষ প্রতিবেদন : প্রতি মাসেই ১১টি ব্যক্তি ও পরিবারের অর্থপাচারের সর্বশেষ চিত্র ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের সর্বশেষ তথ্য প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধার সম্পর্কিত ট্রাস্কফোর্স প্রধান উপদেষ্টাকে এ সংক্রান্ত তথ্য জানানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আদালতের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার দেশী-বিদেশী সম্পদ জব্দ করেছে। এর মধ্যে দেশীয় সম্পদ ৪৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং বিদেশী সম্পদ ১০ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা জব্দ করেছে। দেশী সম্পদের মধ্যে সাত হাজার ৭৭৪ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ এবং অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ৩৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা। বিদেশী সম্পদের মধ্যে ছয় হাজার ৯৭ কোটি টাকা স্থাবর সম্পদ এবং অস্থাবর সম্পদ চার হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। সবমিলে ১৩ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা স্থাবর সম্পদ এবং অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা।