অনিরাপদ হয়ে উঠছে ঢাকা

দ্রুত নগরায়ন, দখল, দূষণ, ধারণক্ষমতার ১০ গুণ মানুষ, কয়েকগুণ বেশি যানবাহন, নদী, জলাধার, পুকুর দখল, সবুজায়ন উধাও এর কারণ। অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিকম্পের শঙ্কা, অগ্নিকাণ্ডের শঙ্কা, এসবের প্রভাবে ঢাকা এখন আতঙ্কের নাগরীতে পরিণত হয়েছে।

আবুল কালাম
Printed Edition

ঢাকা এখন নাগরিকদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত নগরায়ন, দখল, দূষণ, ধারণক্ষমতার ১০ গুণ মানুষ, কয়েকগুণ বেশি যানবাহন, নদী, জলাধার, পুকুর দখল, সবুজায়ন উধাও এর কারণ। অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিকম্পের শঙ্কা, অগ্নিকাণ্ডের শঙ্কা, এসবের প্রভাবে ঢাকা এখন আতঙ্কের নাগরীতে পরিণত হয়েছে। গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত আলাপকালে তারা এসব কথা বলেন।

পরিবেশবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও মানারাত ইন্টার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. মোহাম্মদ আবদুর রব বলছেন, বর্তমান অবস্থায় ঢাকা বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, এ শহর এখন বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল শহরের খ্যাতি অর্জন করেছে। তার ভাষ্য, কয়েক বছর থেকে পৃথিবীর সবচাইতে দূষিত নগরীর তালিকার শীর্ষে এখন প্রায়ই উঠে আসছে ঢাকার নাম। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন শহর থেকে মানুষ ঢাকায় এসে স্থায়ী হচ্ছে। তাদের আবাসনে রাজধানীতে প্রতি বছর উঁচু ভবন বাড়ার সাথে ঢাকার ওপর প্রতিদিন নতুন করে চাপ বাড়ছে।

অনেক আগেই ঢাকা বাসযোগ্যতা হারিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নগরীতে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ মানুষ হওয়াতে তাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, রাস্তাঘাট, অতিরিক্ত গাড়ির চাপে ট্রাফিক-ব্যবস্থা, সবুজায়ন, খেলার মাঠ, পার্ক, শিক্ষাব্যবস্থাসহ সবধরনের নাগরিকসুবিধা ভেঙে পড়েছে। এতে আমাদের প্রজন্ম স্থবির হয়ে বড় হচ্ছে। সেই সাথে দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, সবুজায়ন, পর্যাপ্ত জলাধার, নদীনালা, খালবিল যা ছিল তাও ধীরে ধীরে ভরাট করে নগরীর মধ্যে অপরিকল্পিভাবে নতুন নতুন বাণিজ্যিক ভবন, হাসপতাল, স্কুল-কলেজ, ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এতে করে শব্দদূষণ, পরিবেশদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এতে করে পরিবেশদূষণ, শব্দদূষণ, পয়োনিষ্কাশন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকা একটা বিস্ফোরণে¥ামুখ পরিস্থিতিতে পড়েছে। মন্থর গতির কারণে মানুষ কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। তাতে অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে আগামীতে এমন দিন আসবে যেখানে এ নগরীতে যান বাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়বে। ফলে আগামী কয়েক বছরে ভূমিকম্প, আগ্নিকাণ্ড, পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানান কারণে ঢাকা একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়বে।

অন্য দিকে অরেক পরিবেশবিজ্ঞানী ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকা অনেক আগেই মানুষের জন্য অযোগ্য অনিরাপদ নগরীরতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তো দূরে থাক। আমাদের দেশীয় মানদণ্ডেও ঢাকা এখন বসবাসের অযোগ্য বলে বিবেচিত। কারণ পানি, মাটি, বায়ু, আলো, বর্জ্য ও পরিবেশদূষণসহ নানা কারণে ঢাকা এখন দূষণের স্বর্গরাজ্য।

তার ভাষ্য, ঢাকা একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভবন ভূমিকম্পে ধসে পড়ে ব্যাপক হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে। খেলার মাঠ দখল করে ক্লাব, বিপণিবিতান, হাটবাজারসহ নানা স্থাপনা এবং জলাভূমি ভরাট করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করায় সবুজ ও জলাভূমি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে।

অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনে অতিরিক্ত তাপদাহ, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেও নগরবাসীর দুর্ভোগ বাড়ছে। ঢাকার চার পাশে নদী দখল দূষণ, সবুজায়ন ধ্বংস, পুকুর-খাল, জলাধার দখল- এসব কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। অপরিকল্পিত নগরায়নে প্রতি বছর বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এসব কারণে ঢাকা এখন ভয়ানক অনিরাপদ একটা নগরীতে পরিণত হয়েছে।

এটি সমাধানের বিষয়ে এই দুই বিশেষজ্ঞ বলেন, এর সমাধানে সমন্বিত আরবান প্ল্যানিংয়ের মধ্যে আরবান প্ল্যানার, রিজিয়নাল প্ল্যানার, পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ প্রতিটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এতে তাদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত বাস্তাবায়ন করতে পারলে কিছুটা হলেও তার সমাধান হবে। নয়তো ঢাকা দিন দিন পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে।

এর আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণায় জানায়, অপরিকল্পিত নগরায়নে প্রতিনিয়ত কমছে ঢাকার জলাধার। গত ২৮ বছরে ঢাকার জলাধার ও জলাভূমি কমেছে ৭৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে যেখানে জলাধার ছিল ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে জলাধার কমে হয়েছে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অন্য দিকে ঢাকায় আগুনের ঘটনায় প্রায়ই মৃত্যুর সাথে যুক্ত হয়েছে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা।

আর রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। অন্য দিকে সমীক্ষা বলছে, গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার উধাও হয়ে গেছে। এ সময়ে প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার সবুজের মৃত্যু হয়েছে।

অন্য দিকে একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীর ৬৩% এলাকায় প্রতি একরে ৩০০ জনের বেশি মানুষ বাস করে। এর মধ্যে জনবসতির দিক দিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন। অন্য দিকে বিআইপির হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ঢাকার চার এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া ও সবুজবাগে প্রতি একরে ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষ বাস করে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। আর সবশেষ তথ্যানুযায়ী ২০ সাল থেকে তিন বছরে ঢাকায় লোকসংখ্যা ৩.২৬ শতাংশ বেড়ে ২৩ সালে দাঁড়ায় দুই কোটি ৩২ লাখ ১০ হাজার। আর জনশুমারি প্রতিবেন অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে বসবাসকারীর সংখ্যা চার কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন।

অন্য দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে রাজধানীতে ধারণক্ষমতার চেয়েও প্রায় ছয়গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করছে। কিন্তু ঢাকা শহরের রাস্তায় দৈনিক দুই লাখ গাড়ি চলাচলের সক্ষমতা আছে; কিন্তু গাড়ি চলাচল করছে ১২ লাখ। ফলে যানজট লেগেই থাকছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স-২০২৩-এর প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা ১৬৬তম অবস্থানে রয়েছে। তালিকায় ১৭৩টি দেশের মধ্যে এ নগরীর অবস্থান নিচের দিক থেকে সপ্তম।