নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- আগামীকাল মুক্তি পাচ্ছে ইসরাইলি বন্দীরা
- গাজা সিটিতে ফিরেছেন আড়াই লাখ মানুষ
- গাজার শাসক ফিলিস্তিনিরাই ঠিক করবে
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির কার্যকর হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লাশ উদ্ধার শুরু হয়েছে। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানায়, গত শুক্রবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৫৫ লাশ আনা হয়। তার মধ্যে ১৩৫ লাশ ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করা হয়েছে। যুদ্ধবিরতির ফলে উদ্ধারকর্মীরা প্রথমবারের মতো প্রবেশ করতে পেরেছেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতে।
এ দিকে হামাস-নিয়ন্ত্রিত বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গতকাল শনিবার এক দিনেই প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গাজা সিটিতে ফিরেছেন। সংস্থার কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-মুগাইয়ির বলেন, ‘গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট প্রায় আড়াই লাখ মানুষ গাজা সিটিতে ফিরে এসেছেন।’
চুক্তি বাস্তবায়নের পর গত দিনে গাজার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকেও বহু লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, এর মধ্যে ৪৩টি লাশ পাঠানো হয়েছে আল-শিফা হাসপাতালে এবং ৬০টি আল-আহলি আরব হাসপাতালে। নুসেইরাত, দেইর আল-বালাহ এবং খান ইউনুসের হাসপাতালগুলোতেও লাশ পৌঁছানো খবর পাওয়া গেছে।
অন্য দিকে চিকিৎসা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ইসরাইলি বিমান হামলায় আরো ১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং একজন আহত অবস্থায় মারা গেছেন। গাজা সিটির দক্ষিণে গাবাউন পরিবারের বাড়িতে ভোররাতে চালানো হামলায় একই পরিবারের ১৬ জন নিহত হন। শেখ রাদওয়ানে একজন এবং খান ইউনুসের কাছে আরো দুইজন নিহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতির সময় দুপুর ১২টা (স্থানীয় সময়) থেকে কার্যকর হওয়ার পর এসব হামলা সংঘটিত হয়েছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
ধ্বংসস্তূপে ফিরে যাওয়া : ইসরাইলি বাহিনী গাজার কিছু অংশ থেকে সরে যাওয়ার পর এবং উপকূলীয় আল-রাশিদ সড়ক পুনরায় খুলে দেয়ায় হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িগুলোর দিকে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। আলজাজিরার তারেক আবু আজজুম নুসেইরাত থেকে জানিয়েছেন, ‘শিশু, নারী, বৃদ্ধ, গাড়ি, ভ্যান, আসবাবপত্র বোঝাই গাধার গাড়ি সবই গাজা সিটির দিকে যাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পরিবারগুলো তাদের অস্থায়ী তাঁবু খুলে নিয়ে ধ্বংসস্তূপের ওপর পুনরায় স্থাপন করতে শুরু করেছে।’ তিনি মন্তব্য করেন, ‘এই ফিরে আসা ঐতিহাসিক, তবে মানবিক সঙ্কট নিরসনে বাস্তব পদক্ষেপের প্রয়োজন।’
গাজা সিটি এখন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস। মাসের পর মাস ধরে ইসরাইলি বোমাবর্ষণের ফলে শহরের কোনো অবকাঠামোই কার্যকর নেই, নেই বিশুদ্ধ পানি, নেই বিদ্যুৎ, শুধু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়ির কঙ্কালসার অবশিষ্টাংশ। দেইর আল-বালাহ থেকে আলজাজিরার মোআথ খালুত বলেন, ‘ফিরে আসা পরিবারগুলোর জন্য এখন জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী তাঁবু ও মোবাইল আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন।’ তিনি আরো বলেন, ‘যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা নিয়েই তারা অজানার পথে যাত্রা করছে।’
‘অবিশ্বাস্য সহনশীলতা’ : অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতির পরও ফিলিস্তিনিরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজের অস্থায়ী তাঁবু গাড়িতে তুলে নেয়ার সময় নাঈম ইরহিম আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমি গাজা সিটিতে যাচ্ছি, যদিও সেখানে জীবনযাপনের কোনো উপযোগী অবস্থা নেই, নেই অবকাঠামো, নেই বিশুদ্ধ পানি। সবকিছুই অত্যন্ত কঠিন, সত্যিই কঠিন; কিন্তু আমাদের ফিরতেই হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে নিহত হয়েছে, আমার সব মেয়েরা আহত। তবুও আমি ফিরতে চাই। আমরা একটি তাঁবু খাটাব এবং যেভাবে সম্ভব, সেভাবেই সেখানে বসবাস করব।’
অনেকের জন্য গাজা সিটিতে ফিরে যাওয়া মানে শুধু ছাইয়ের মুখোমুখি হওয়া। তবে খালুত বলেন, ‘প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি দখলের অধীনে অভাবনীয় সহনশীলতা দেখিয়েছে। প্রতিটি ফিরে আসা শুধু প্রত্যাবর্তন নয়, এটি প্রতিরোধ এবং আশার প্রতীক।’ ইসরাইলি যুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়া আয়েশা শামাখ বলেন, ‘আমরা আমাদের বাড়িগুলো দেখতে চাই, যেসব বাড়ি যুদ্ধের শুরুতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের সন্তানদের উপর ছাদের ফ্লোর ধসে পড়েছে; কিন্তু যুদ্ধবিরতির আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না।’
ক্ষতির মধ্যেও জীবনের স্পন্দন : গাজা সিটিতে আলজাজিরার ইব্রাহিম আল-খালিল জানিয়েছেন, ‘ফিরে আসা মানুষের মুখে ক্ল¬ান্তি, শোক এবং আনন্দের মিশ্র অনুভূতি।’ তিনি বলেন, ‘অনেকে জানেন না তাদের বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কি না, নাকি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তবুও তারা আশাকে আঁকড়ে ধরে ফিরছেন।’ উত্তরের দিকে কঠিন যাত্রা শেষে আহমেদ আবু শানাব আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না, আমরা ঠিকমতো ঘুমাতেও পারিনি।’
আরেক বাসিন্দা মরিয়ম আবু জাবাল বলেন, ‘আমরা অজানার দিকে ফিরে এসেছি, জানি না আমাদের বাড়ি এখনো আছে কি না। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন আমাদের বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে থাকে।’ শেখ রাদওয়ান এলাকায় ফিরে আসা মোহাম্মদ শরাফ বলেন, ‘সবকিছু বদলে গেছে। আমরা এমন এক বিপর্যয়ে ফিরে এসেছি, যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমরা ভেবেছিলাম কয়েক দিনের জন্য যাচ্ছি, এখন ফিরে এসে দেখছি কিছুই নেই।’ মৃত্যু, শোক এবং ধ্বংসের মধ্যেও ফিরে আসার এই ইচ্ছা একটি শক্তিশালী বার্তা- একটি জাতি তাদের ভূমি থেকে মুছে ফেলা বা উৎখাত হওয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, ইসরাইলের মুখোমুখি হয়ে।
ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস আগামীকাল সোমবার গাজা থেকে ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি দেবে বলে ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত বৃহস্পতিবার রাতে হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেছেন, হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে বন্দী থাকা ২০ জন জীবিত এবং ২৮ জন নিহত বন্দীর লাশ সোমবার হস্তান্তর করা হবে। এটি মার্কিন মধ্যস্থতায় হওয়া শান্তিচুক্তির অংশ বলে এক খবরে বলেছে টাইমস অব ইসরাইল।
ট্রাম্প বলেন, সোমবার বড়দিন হবে। ওই দিন বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়ায় ৪৮ জন ইসরাইলি (জীবিত ও মৃত) মুক্তি পাবে এবং এর বিপরীতে অন্তত দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দী ইসরাইলের জেল থেকে মুক্তি পাবে। তিনি উল্লেখ করেন, কিছু লাশ এখনো উদ্ধারাধীন এবং এটা এক বিশাল ট্র্যাজেডি। জীবিত বন্দীদের পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাম্প বলেন, তারা এমন কিছু কঠিন জায়গায় আছে, যেখানে কেবল কিছু মানুষই তাদের অবস্থান জানে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, তার শান্তিচুক্তির প্রথম এবং পরবর্তী পর্যায় সফল হবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, হামাস ও ইসরাইল উভয়ই যুদ্ধ নিয়ে ক্লান্ত এবং বেশির ভাগ বিষয়ে একমত। তিনি যোগ করেন, সুন্দর একটি কক্ষে বসে সমস্যার সমাধান সহজ, বাস্তবে কিছুটা কঠিন। ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইরান এবং রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ায় খুশি এবং উল্লেখ করেন, শান্তি পরিকল্পনা কেবল গাজার জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বিস্তৃত হবে। তিনি বলেন, এটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এবং একটি সুন্দর বিষয়। আগামী সপ্তাহের শেষে ট্রাম্প মিসরের কায়রো সফরে যাবেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি ইসরাইলে সফর করবেন এবং দেশটির পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেবেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেবেন। গাজার জন্য মার্কিন মধ্যস্থতায় হওয়া শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী, হামাস ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দী মুক্তি দেয়ার জন্য সম্মত হয়েছে। ইসরাইলও শুক্রবার ভোরে চুক্তি অনুমোদন করে এবং সেনারা গাজার বিভিন্ন এলাকা থেকে নির্ধারিত অবস্থানে ফিরে যায়।
গাজা শাসন : ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও এর সহযোগী দলগুলো বলছে, এ উপত্যকার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ‘ফিলিস্তিনিদের নিজেদের বিষয়’। ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) গত শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে সংগঠন দু’টি গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থার বিষয়ে হামাসের অবস্থানের সাথে একমত পোষণ করেছে। একই সাথে বিবৃতিতে ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তার প্রশংসা করা হয়েছে। সংগঠনগুলো বলছে, গাজা উপত্যকা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার ক্ষেত্রে ইসরাইলের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যেকোনো বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে আমরা আবারো নিজেদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি। আমরা জোর দিয়ে বলছি, গাজা উপত্যকা ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন কেমন হবে, সেটি ফিলিস্তিনিদের নিজেদের বিষয়। এটা আমাদের জনগণ তাদের সম্মিলিত প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সরাসরি নির্ধারণ করবেন।’ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি ‘জরুরি জাতীয় বৈঠক’ আয়োজনে কাজ করার কথাও বিবৃতিতে জানিয়েছে সংগঠন দু’টি।
এ বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এটি ফিলিস্তিনিদের অবস্থানকে ঐক্যবদ্ধ করবে। একটি বিস্তৃত জাতীয় কৌশল প্রণয়ন এবং অংশীদারত্ব, বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করবে।’ তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ওপর প্রভাব রাখা দল ফাতাহ এ বৈঠকের অংশ হতে রাজি হয়েছে কি না, সেটি স্পষ্ট নয়।
টাস্কফোর্সে যোগদানে প্রস্তুত তুরস্ক : গাজা টাস্কফোর্সের অংশ হিসেবে তাদের ওপর অর্পিত যেকোনো মিশন গ্রহণ করতে তাদের সশস্ত্রবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে তুরস্কের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। শুক্রবার এ তথ্য জানায় মন্ত্রণালয়টি। দেশটির সংবাদমাধ্যম আনাদোলুর খবরে বলা হয়, তুর্কি বাহিনী গাজা টাস্কফোর্সে যোগ দেবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেকি আকতুর্ক বলেন- বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দ্বারা আয়োজিত অসংখ্য আন্তর্জাতিক মিশনে সেনাবাহিনী আগে অংশগ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, তুর্কি সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং ন্যায্য অবস্থান সব পক্ষের সম্মান অর্জন করেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্যাপক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আমাদের সশস্ত্রবাহিনী তাদের ওপর অর্পিত যেকোনো মিশন গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আকতুর্ক সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, তুর্কির মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার ফলে গাজায় যুদ্ধবিরতি সম্পন্ন হয়েছে। তিনি গত দুই বছর ধরে তীব্র মানবিক সঙ্কটের সম্মুখীন এই অঞ্চলে মানবিক সহায়তা প্রদান এবং পুনর্গঠন শুরু করার জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা আশা করি যুদ্ধবিরতি একটি ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে এবং শেষ পর্যন্ত দুই-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পরিবেশ তৈরি করবে। শুক্রবার গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে সেনা প্রত্যাহার শুরুর পর এই মন্তব্য করল তুরস্ক।