বিএনপিতে বিভক্তি প্রভাব ফেলছে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়

মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল

অর্ধশতাধিক আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তি যেমন নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন, তেমনি তার বিরুদ্ধে দলের আরেকটি পক্ষ নানা অভিযোগ নিয়ে মাঠে রয়েছে। বিরোধী পক্ষ প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচি দিয়ে বিভক্তি জিইয়ে রাখছে। যারা দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাদের অভিযোগ- বিগত দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে না থাকা, বিতর্কিত আর সুবিধাভোগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। তারা মনোনয়ন পরিবর্তন করে ত্যাগী, যোগ্য, অপেক্ষাকৃত তরুণ আর ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্ট কোন্দল-বিভক্তি প্রভাব ফেলছে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়। অর্ধশতাধিক আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তি যেমন নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন, তেমনি তার বিরুদ্ধে দলের আরেকটি পক্ষ নানা অভিযোগ নিয়ে মাঠে রয়েছে। বিরোধী পক্ষ প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচি দিয়ে বিভক্তি জিইয়ে রাখছে। যারা দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাদের অভিযোগ- বিগত দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে না থাকা, বিতর্কিত আর সুবিধাভোগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। তারা মনোনয়ন পরিবর্তন করে ত্যাগী, যোগ্য, অপেক্ষাকৃত তরুণ আর ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, মনোনয়ন নিয়ে এ ধরনের কোন্দলে তারা সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন। নির্বাচনী মাঠে তারা এখন দ্বিধাবিভক্ত। তফসিল দেয়ার পরেও এটা বহাল থাকলে এর সুবিধা পাবে প্রতিপক্ষ। কেন্দ্র থেকে কোন্দল নিরসনের জন্য কঠোর মনোভাব দেখানো হলেও তা মাঠপর্যায়ে প্রভাব পড়ছে না। অযোগ্য আর বিতর্কিত নেতাকে মনোনয়ন দেয়ার কারণেই এই সমস্যার সৃষ্টি। সেখানে যদি মনোনয়ন বদল করা না হয় তাহলে বিরূপ ফলাফল আসতে পারে বলেও তারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

গত ৩ নভেম্বর ২৩৭টি আসনে সম্ভ্যাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বিএনপি এবং এর এক মাস পর গত ৪ ডিসেম্বর আরো ৩৬টি আসনের প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। আগে ঘোষিত একটি আসনের প্রার্থী পরিবর্তন করায় সারা দেশে মোট ২৭২ আসনে নিজ দলীয় প্রার্থী দেয় দলটি। প্রথম দফা সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংক্ষুব্ধরা বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করে প্রার্থী বদলের দাবি জানিয়ে আসছে। অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় কার্যালয়েও জমা হয়েছে লিখিত অভিযোগ।

গত ৩ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর চট্টগ্রাম-১২ আসনের ৬৮০ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দেন। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী এনামুল হক এনামকে পরিবর্তন করে ধানের শীষের প্রার্থী চূড়ান্ত করার আবেদন জানিয়েছেন তারা। আবেদনে তারা এনামকে চাঁদাবাজ ও বিতর্কিত উল্লেখ করে বলেন, এনামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে নিরীহ মানুষের প্রতি এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি, চাঁদাবাজি, মামলা বাণিজ্য ও এস আলমের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পটিয়া পৌরসভা ও ১৭টি ইউনিয়নসহ প্রত্যেক গ্রামের জনগণের প্রবল আপত্তি রয়েছে।

অভিযোগে তারা আরো বলেন, এলাকায় চাঁদাবাজি, মামলা বাণিজ্য, বালুমহল দখল, পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও তাহাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে সমালোচিত এনাম এলাকার সিনিয়র বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে তার অনুসারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ মাফিয়া লোকজন নিয়ে বেয়াদবি ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও সমালোচনা করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছেন। এ ছাড়া অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করে এলাকায় মাদকের স্বর্গরাজ্য ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ফলে দলীয় ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হয়।

পটিয়া উপজেলা বিএনপির নেতা মিজবাহুল চৌধুরী বলেন, এই আসনে আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার ও বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদের মতো পরিচ্ছন্ন আর কর্মীবান্ধব নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হলে আসনটি বিএনপির হতে পারত।

গত ২৩ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী সাদিক রিয়াজ পিনাক চৌধুরীর বিরুদ্ধে একই আসনের অপরাপর তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সহসভাপতি মোজাহারুল ইসলাম, জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ কালু এবং জেলা বিএনপির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক কেন্দ্রীয় শিক্ষক নেতা অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম লিখিত অভিযোগে বলেন, সাদিক রিয়াজ ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আরাম আয়েশে ব্যবসায়িক সুবিধা লাভ করেছেন। ২০২৩ সালে প্রথম ও একমাত্র রাজনৈতিক মামলার শিকার হন এবং নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে জামিন পেয়ে যান। এ জন্য তাকে কারাবরণ করতে হয়নি। আওয়ামী লীগের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সুপারিশে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। এর ফলস্বরূপ তিনি খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার একটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ৫ আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন মিল-কারখানা থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নিজদলীয় কর্মীকে হত্যাচেষ্টা, মাদকের সাথে সম্পৃক্ততার তথ্যও তুলে ধরেন ওই তিন নেতা।

গত ২৯ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের দুই উপজেলা বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা লিখিত অভিযোগে বলেন, এই আসনে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রার্থী মুশফিকুর রহমান বিগত ১৭ বছর কানাডা প্রবাসী ছিলেন। নব্বই বছরের বয়োবৃদ্ধ এই নেতা অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাচল করতে পারেন না। কোনো গণসংযোগও করতে পারেন না। শারীরিকভাবে এমন অক্ষম নেতা প্রার্থী হিসেবে বহাল থাকলে আগামীতে নিশ্চিত পরাজয়বরণ করতে হবে।

আখাউড়া পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকতার খান বলেন, এই আসনে বিগত আন্দোলন সংগ্রামে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন, মাঠে ছিলেন কবীর আহমেদ ভূঁইয়া। তরুণ এই নেতাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করায় শুধু দলের নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে।

কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী মেহেদী হাসান রুমীকে পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে দুই উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতারা লিখিত অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, রুমী বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ নেতা। তার পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম সম্ভব না। বিগত দিনে তিনি দলে সক্রিয় ছিলেন না। নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন না। আসনটিতে প্রার্থী বদল না হলে হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন ওইসব নেতারা।

খোকসা উপজেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, এই আসনে দীর্ঘদিন ধরে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাদী। তরুণ মার্জিত আর শিক্ষিত হিসেবে এলাকায় তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। সেখানে তাকে না দিয়ে একজন বয়োবৃদ্ধকে মনোনয়ন দেয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

গত ১৯ নভেম্বর তারেক রহমান বরাবর এক চিঠিতে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের বিরুদ্ধে অপর সাত মনোনয়ন প্রত্যাশী অভিযোগ করেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী মান্নান ও তার ছেলে এলাকায় চাঁদাবাজি, দখল, নদীপথে চাঁদাবাজি, মামলা-মোকদ্দমা, বালুমহাল দখলসহ নানান অপকর্মে জড়িয়েছেন। ফ্যাসিস্ট দোসর আর জাতীয় পার্টির নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলছেন। এ ছাড়া দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় বিএনপি নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ ভোটারদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেয়া আরেক অভিযোগে জামালপুর-২ আসনের নেতাকর্মীরা জানান, এই আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সুলতান মাহমুদ বাবুকে। বয়সের ভারে অসুস্থ এই নেতাও ওয়ান-ইলেভেনে সংস্কারপন্থী ছিলেন। এর আগে কে এম ওবায়দুর রহমানের সাথেও দল ভেঙে চলে গিয়েছিলেন। বিগত দিনে আওয়ামী লীগের সাথে সখ্যতার কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা কিংবা জিডিও হয়নি। এই আসনে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এএসএম আব্দুল হালিম উচ্চশিক্ষিত, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় আর ত্যাগী নেতা হিসেবে এলাকায় সমধিক সমাদৃত। এই আসনের ইসলামপুর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলে সর্বোচ্চ ভোট রয়েছে। সেখানেই তার বাড়ি হওয়ায় ভোটের রাজনীতিতে তিনি এগিয়ে থাকবেন বলে দাবি করেন নেতাকর্মীরা।

গত ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির এক আবেদনে নেতারা জানান, চট্টগ্রাম-১৩ আসনে সরওয়ার জামাল নিজাম প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন। ৮০ বছরেরও বেশি বয়স্ক এই নেতা দীর্ঘ সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় সাবেক সংসদ-সদস্য সরওয়ার জামাল নিজামের নাম দেখে অনেকেই হতবাক ও ব্যথিত হয়েছেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত কর্মী হিসেবে বিএনপি ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে প্রতিনিয়ত আন্দোলন করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস বলেন, দলের দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রামে ছিল এ রকম কাউকে দলীয় প্রার্থী দেয়ার জন্য দলের হাইকমান্ডের কাছে আবেদন করছেন।

নৈতিক স্খলনের একাধিক ভিডিও চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ায় নেত্রকোনা সংসদীয় আসন নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা উপজেলা) বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রাথমিক সম্ভাব্য ঘোষিত প্রার্থী আবু তাহের তালুকদারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই আসনে প্রার্থী পরিবর্তন না হলে শুধু নারী ভোটার নয়, সাধারণ ভোটারও বিমুখ হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন উপজেলা বিএনপির সদস্য ইকরামুল আলম।

সিরাজগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন আইনুল হক। তার বিরুদ্ধে এলাকায় নানা অভিযোগ রয়েছে। এ আসনে মনোনয়নের জন্য বিএনপির দুঃসময়ের নেতাদের বিবেচনা করা হয়নি বলে ক্ষোভ জানান স্থানীয় বিএনপির নেতারা। তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী আইনুল হকের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এসব বিষয়ে বলেন, কয়েক দফা মাঠ জরিপ, সাংগঠনিক নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে এবারের সম্ভ্যাব্য প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এই তালিকায় প্রয়োজন অনুসারে কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই কোন্দল মেনে নেয়া হবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে যেতে হবে। এ জন্য যা যা করার দরকার দল তাই করবে।