বিশেষ সংবাদদাতা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ চূড়ান্তকরণ ও গণভোট আয়োজনের সময়সূচি নির্ধারণ নিয়ে একমত হতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্বর্তী সরকার এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের প্রেক্ষাপটে গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় এ সময় দেয়া হয়। সভায় উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যরা বলেছেন, জুলাই সনদে বর্ণিত সংস্কার বাস্তবায়নে আর সময়ক্ষেপণ চলবে না; রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান জানাতে হবে।
সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘গণভোট ও সনদ চূড়ান্ত করার সময় এসে গেছে। দলগুলো এখন যদি মতৈক্যে না পৌঁছায়, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনিশ্চয়তায় পড়বে।’
জুলাই সনদ ও গণভোট নিয়ে দ্রুত সব দলের অভিন্ন মত চায় সরকার
জুলাই জাতীয় সনদ, গণভোট বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে- তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ-উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এক সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারে, তাহলে সরকার তার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি সভায়’ এই সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করে প্রেস উইং। এ সময়ে আসিফ নজরুল ছাড়া কেউ কোনো কথা বলেননি। তবে তাদের সবাইকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল একটি সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্যে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জুলাই জাতীয় সনদ, সংবিধান সংস্কার চূড়ান্ত করা এবং এতে উল্লিখিত গণভোট আয়োজন ও গণভোটের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সভায় লক্ষ করা হয়, দীর্ঘদিন আলোচনা করার পরও কয়েকটি সংস্কারের সুপারিশের বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। এ ছাড়া গণভোট কবে ও তার বিষয়বস্তু কী হবে-এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে গণভোটের সময় কখন হবে, কবে অনুষ্ঠিত হবে, গণভোটের বিষয়বস্তু কী হবে, জুলাই সনদে বর্ণিত ভিন্নমত প্রসঙ্গে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে- এগুলোসহ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলোর আলোকে জরুরি ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে সভায় অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিনের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো নিজ উদ্যোগ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে, সম্ভব হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। দিকনির্দেশনা পেলে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া অত্যন্ত সহজ হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। সেটি সভায় বিবেচনায় রাখা হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের সঙ্কল্প পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক জানতে চান, কবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি হতে পারে? জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একটু সময় দিতে চাই। কারণ তারা ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করেছেন।
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণভোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- এর জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, আজকের বৈঠকে যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটি আপনাদের কাছে বলা হয়েছে। এর বাইরে আমাদের কিছু বলার নেই।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার জন্য এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে। তারা যদি আলোচনায় ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকার কী করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা কোনো আলটিমেটাম দিইনি, আহ্বান জানিয়েছি। আলটিমেটাম শব্দটি নিয়ে আমি আপত্তি করছি। আমরা অপেক্ষা করব। তারপর সরকার অবশ্যই সরকারের মতো পদক্ষেপ নেবে।’
সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আলোচনার আয়োজন করে দেবে কি না- এমন প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, সরকার বহু আলোচনা করেছে। সরকার আর কোনো আয়োজন করতে যাচ্ছে না। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ১৫ বছরে আলোচনা করে বহু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা অত্যন্ত প্রতিকূল সময়ে একসাথে আন্দোলন করেছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তারা নিজেরা আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দেবে- এই প্রত্যাশা সরকার করছে। কালকেই দেখলাম একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আলোচনা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আমরা একে স্বাগত জানাই।
আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, একটি বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষে অভিযোগ করা হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশনে যে বিষয়গুলো আলাপ-আলোচনা করা হয়েছিল, বাস্তবায়ন সুপারিশে এসে, সেই আলাপ-আলোচনার বিষয়গুলোর ব্যত্যয় ঘটেছে বা সম্পূর্ণভাবে সেগুলো রক্ষা করা হয়নি।
এর জবাবে কোনো মন্তব্য নেই বলে জানান আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা আলাপ-আলোচনা করে এই বিষয়েও আমাদের একটি ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দেবে প্রত্যাশা করছি। ওনারা যদি আলাপ-আলোচনা করেন, আমাদের জন্য কাজটি অত্যন্ত সহজ হয়। ওনারা যদি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে না পারেন, অবশ্যই সরকার সরকারের মতো সিদ্ধান্ত নেবে।’
সরকারের প্রায় ১৫ মাস হয়ে গেলেও এর আগে কোনো সংবাদ সম্মেলন প্রধান উপদেষ্টা বা তার কার্যালয় আয়োজন করা হয়নি। সাধারণত, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ফরেইন সার্ভিস একাডেমি বা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় সংবাদ সম্মেলন করে থাকে।
গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়েছে, সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।
তবে গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সাথে হবে, নাকি আগে হবে। এসব সুপারিশ জমা দেয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল জরুরি বৈঠকে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
ভিন্নমতের পয়েন্ট : কোথায় আটকে আছে ঐকমত্য
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাগুলোতে যে তিনটি বিষয়ে প্রধান মতবিরোধ দেখা দিয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সেগুলোই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এর মধ্যে রয়েছে-
১. সংসদ কাঠামো : প্রস্তাবিত ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ’-যেখানে একটি নি¤œকক্ষ সরাসরি নির্বাচিত, আর উচ্চকক্ষ নিয়ে বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে।
২. নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন: নাগরিক প্রতিনিধি ও পেশাজীবী সংস্থাগুলোর অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবে কিছু দল ‘রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা’র আশঙ্কা করছে।
৩. গণভোটের সময়সূচি: ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ, এই সময় নিয়ে বিরোধ চলছে। সরকারের অভিমত, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঘোষণার আগে গণভোট শেষ করতে হবে।
ভবিষ্যৎ পরিণতি : সময়ের চাপে সিদ্ধান্তের তাগিদ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উপদেষ্টা পরিষদের গতকালের সভা “চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সূচনা বিন্দু”।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন দু’টি পথ-এক, দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছে গণভোটের মাধ্যমে বৈধতা নিশ্চিত করা; দুই, বিলম্ব করে রাজনৈতিক আস্থার সঙ্কটে পড়া। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নির্ভর করছে এই ভারসাম্যের ওপর।’
অর্থনীতিবিদরা আরো সতর্ক করেছেন যে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘ হলে সংস্কারপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও বিনিয়োগও ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘের গভর্ন্যান্স সাপোর্ট মিশন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেমোক্র্যাসি ফান্ড জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপরই ভবিষ্যৎ সহায়তা নির্ভর করছে।
বিশ্লেষণ : ঐকমত্যের পরীক্ষা, সংবিধান সংস্কারের ভবিষ্যৎ
জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জুলাই সনদ একদিকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে নতুন মতবিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
উপদেষ্টা পরিষদের আজকের বার্তা স্পষ্ট- ‘আর দেরি নয়।’ সরকার চায় গণভোটের মাধ্যমে জনগণ সরাসরি জানাক, তারা নতুন সংবিধান কাঠামো চায় কি না।
কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঐকমত্যের অভাব যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ফেব্রুয়ারি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে- যা অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলবে।
অতএব, আগামী এক সপ্তাহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মোড় নেয়ার সময় হয়ে উঠছে- যেখানে ‘জুলাই বিপ্লবের’ চেতনা ও ‘প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের’ বাস্তবতা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
উপদেষ্টা পরিষদের গতকালের বার্তা ছিল সতর্ক ও দৃঢ়- রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া রূপান্তর অসম্পূর্ণ থাকবে। কিন্তু এই ঐকমত্যের সময়সীমা এখন আর মাস নয়, কেবল এক সপ্তাহ।
 


