দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত দেশের একমাত্র হার্ডরক খনিজ মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল) বর্তমানে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। খনির স্ট্যাক ইয়ার্ডে প্রায় ১১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন পাথর মজুদ হয়ে আছে, অথচ প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন উৎপাদন অব্যাহত থাকায় রাখার জায়গা ফুরিয়ে আসছে। প্রকৌশলীরা সতর্ক করছেন এভাবে চলতে থাকলে খনিতে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে।
মান আছে, বাজার নেই : এমজিএমসিএলের উৎপাদিত গ্রানাইট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), এলজিইডি এবং সড়ক গবেষণাগার কর্তৃক মানসম্মত প্রমাণিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এটি আমদানিকৃত পাথরের তুলনায় উন্নতমানের ও সাশ্রয়ী। কিন্তু সরকারি প্রকল্প এবং ঠিকাদাররা এখনো বিদেশী পাথরের প্রতি নির্ভরশীল থাকায় দেশীয় পাথর বাজারে স্থান পাচ্ছে না। এটি এক ধরনের বৈপরীত্য তৈরি করেছে, যেখানে দেশেই বিশ্বমানের সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি চলছে।
মজুদের চিত্র : আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত খনিতে জমে থাকা পাথরের চিত্র হলো- রেলওয়ে ব্যালাস্ট : ৬,৯০০০০ মেট্রিক টন, বোল্ডার (নদী শাসনে) : ৩,২০,০০০ মেট্রিক টন, স্টোন ডাস্ট : ১,১০,০০০ মেট্রিক টন, মাঝারি আকারের পাথর (৬০-৮০ মিমি) : ৩০,০০০ মেট্রিক টন, ছোট আকারের পাথর (৫-২০ মিমি) : ১০,০০০ মেট্রিক টন, ২০-৪০ মিমি আকারের পাথর : ১,০০০ মেট্রিক টন।
সবচেয়ে বড় জট তৈরি হয়েছে রেলওয়ে ব্যালাস্টে। এ বছরই রেলওয়ের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সাথে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল। সেখানে প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন ব্যালাস্ট সরবরাহের কথা থাকলেও বাস্তবে গ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। পশ্চিমাঞ্চল ১,০১,৪৩৯ মেট্রিক টনের বিপরীতে নিয়েছে মাত্র ৬৭,১০৭ মেট্রিক টন এবং পূর্বাঞ্চল ৩৮,৪৩১ মেট্রিক টনের বিপরীতে নিয়েছে মাত্র ৬,৫৮১ মেট্রিক টন। রেলওয়ে প্রকল্পে বিলম্ব ও ভারতীয় পাথরের ব্যবহারকে এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রকৌশলীরা।
নদী শাসনে বোল্ডারের ব্যবহার উপেক্ষিত
খনির আরেকটি বড় মজুদ হলো ৩,২০,০০০ মেট্রিক টন বোল্ডার। এগুলো নদী শাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাজে অত্যন্ত কার্যকর। প্রকৌশলীরা দাবি করেন, বোল্ডার কংক্রিট ব্লকের তুলনায় বেশি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড (ইডউই) এখনো এই পাথর গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অভ্যাস, ক্রয়পদ্ধতির জটিলতা ও ঠিকাদারদের চাপের কারণে দেশীয় বোল্ডার মূলধারায় প্রবেশ করতে পারছে না।
স্টোন ডাস্ট : আমদানির ফাঁদে দেশীয় খনি : খনির উৎপাদিত স্টোন ডাস্ট এলজিইডি পরীক্ষায় রাস্তা কার্পেটিং ও সিল কোটের জন্য মানসম্মত হিসেবে স্বীকৃত। তবুও প্রকল্পগুলোতে ব্যাপকভাবে বিদেশী ডাস্ট ব্যবহার হচ্ছে। এতে খনির ইয়ার্ডে জমে আছে ১,১০,০০০ মেট্রিক টন ডাস্ট, অথচ একই উপকরণ আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। এটি নীতিগত সমন্বয়ের ঘাটতির স্পষ্ট প্রমাণ।
নীতিগত স্থবিরতা ও কর-ভ্যাটের চাপ : খনির সমস্যার মূল কারণ উৎপাদন সীমাবদ্ধতা নয়, বরং নীতিগত স্থবিরতা। সরকার এখনো পাথর আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে, ফলে দেশীয় উৎপাদন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। অপর দিকে বিস্ফোরক ও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আমদানিতে করের চাপ বেড়ে গেছে। বর্তমানে বিস্ফোরকে শুল্ক ১০৪ শতাংশ এবং অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটে ৩৭ শতাংশ। এর সাথে ডলারের ঊর্ধ্বগতি যুক্ত হয়ে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন- এপ্রিল মাসে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় শুল্ক মওকুফের নির্দেশনা দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
পরিবহন সঙ্কট : চাহিদা থাকলেও পরিবহন ব্যয় একটি বড় বাধা। বর্তমানে ট্রাকে করে পাথর পাঠাতে হচ্ছে, যা ব্যয়বহুল এবং সীমিত সক্ষমতার। অথচ খনি উন্নয়নকালে মধ্যপাড়া থেকে ভবানীপুর পর্যন্ত একটি বিশেষ রেললাইন নির্মাণ হয়েছিল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা অচল হয়ে পড়ে। সম্প্রতি রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল লাইন সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। কাজ শেষ হলে খনির বাজারজাতকরণে গতি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত : এমজিএমসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এম জোবায়েদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে পাথর আমদানি করছে, অথচ দেশেই বিশ্বমানের সম্পদ রয়েছে। সরকারি প্রকল্পে দেশীয় পাথর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে সঙ্কট দূর হবে।’
অন্য দিকে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে মধ্যপাড়া জাতীয় সম্পদ থেকে আর্থিক বোঝায় পরিণত হবে।’
করণীয় : বিশেষজ্ঞদের মতে, সঙ্কট সমাধানে অবিলম্বে নিতে হবে কয়েকটি পদক্ষেপ-রেললাইন সংস্কার করে সাশ্রয়ী পরিবহন নিশ্চিত করা। মজুদ পাথর সরাতে জরুরি নীতিগত নির্দেশনা। সরকারি প্রকল্পে দেশীয় পাথর বাধ্যতামূলক ব্যবহার। ভুটান থেকে বিনা শুল্কে এবং ভারত ও দুবাইসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকৃত পাথরের শুল্ক বৃদ্ধি করে আমদানিকৃত পাথরে শুল্ক আরোপ করে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি। বিক্রীত পাথরের ওপরই রয়্যালটি নির্ধারণ। খনির আধুনিকীকরণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ।
১৯৯০-এর দশকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত মধ্যপাড়া খনি ছিল কৌশলগত সম্পদ। আজ বিশ্বমানের পাথর উৎপাদন করেও নীতিগত অচলাবস্থা, বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং পরিবহন সমস্যার কারণে এটি সঙ্কটে পড়েছে। বাংলাদেশের চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর যুগে দেশীয় সম্পদকে অবহেলা করা মানে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় এবং জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার। এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেয়া মধ্যপাড়াকে কি জাতীয় অবকাঠামোর চালিকাশক্তি করা হবে, নাকি এটি ব্যর্থ বিনিয়োগ হিসেবে ইতিহাসে নথিভুক্ত হবে।