অর্থনীতিতে স্থিতি আছে, গতি নেই

রিজার্ভ-রেমিট্যান্সে স্বস্তি ব্যাংকিং খাতে গভীর সঙ্কট : ঝুঁকির ইঙ্গিত দিচ্ছে সর্বশেষ সূচকে

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহে সাময়িক স্বস্তি দেখা গেলেও, ব্যাংকিং খাতের ভেতরে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

২০২৫ সালের শেষে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহে সাময়িক স্বস্তি দেখা গেলেও, ব্যাংকিং খাতের ভেতরে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভিশনাল ও হালনাগাদ সূচকগুলো (২৮ ডিসেম্বর’২৫) বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়- অর্থনীতি এখন টিকে আছে, কিন্তু স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে না।

রিজার্ভ : ওঠানামার ভেতরেই অস্থিরতা: বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৫ সালে একাধিক পর্যায়ে ওঠানামা করেছে। বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ এক সময়ের ২০.১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে সর্বশেষ পর্যায়ে এটি প্রায় ৩১-৩২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই রিজার্ভের বড় অংশ স্বল্পমেয়াদি আমদানি দায়, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজারে হস্তক্ষেপের ফল। ফলে কাগজে-কলমে রিজার্ভ বাড়লেও, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ বাস্তবে অনেক কম।

রেমিট্যান্স : অর্থনীতির প্রধান ভরসা : অর্থবছর ২০২৫-এ প্রবাসী আয় ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬.৮৩ শতাংশ বেশি। আর চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটিই অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী সূচক।

বিশ্লেষণে দেখা যায়- হুন্ডি দমন কার্যক্রম, প্রণোদনার ধারাবাহিকতা এবং বৈধ চ্যানেলে লেনদেন বৃদ্ধির ফলে রেমিট্যান্স অর্থনীতির জন্য ‘লাইফলাইন’-এ পরিণত হয়েছে। তবে এই অর্থ মূলত আমদানি ব্যয় ও রিজার্ভ ধরে রাখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে নয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ।

আমদানি-রফতানি : কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা রয়ে গেছে : ২০২৫ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে এ সময়ে আমদানি ব্যয় হয় (সিএন্ডএফ) : ৬৮.৩৫ বিলিয়ন ডলার (প্রবৃদ্ধি ২.৪৪%) আর রফতানি আয় হয় (এফওবি) : ৪৩.৯৬ বিলিয়ন ডলার (প্রবৃদ্ধি ৭.৭২%)। চলতি ২০২৬ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি ব্যয় হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৫ শতাংশ বেশি। অন্য দিকে একই সময়ে রফতানি আয় হয় সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার যাতে প্রবৃদ্ধি হয় ২ শতাংশের কাছাকাছি। এতে অক্টোবর শেষে চলতি হিসাবে লেনদেনে ভারসাম্য হয় ইতিবাচক ১২ বিলিয়ন ডলারের মতো, যা আগের বছরের তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বেশি।

রফতানি কিছুটা বাড়লেও আমদানির ওপর নির্ভরতা কমেনি। বিশেষ করে জ্বালানি, শিল্প কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য। এই খাতগুলো আমদানির বড় অংশ দখল করে আছে। ফলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সে চাপ অব্যাহত।

ব্যাংকিং খাত : অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল দিক : সাম্প্রতিক উপাত্তে সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে খেলাপি ঋণ থেকে। খেলাপি ঋণের বিস্ফোরকভাবে বৃদ্ধি ঘটছে। খেলাপি ঋণ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ ছিল- ৯.৯৩%, জুন ২০২৪ এ ১২.৫৬%, ডিসেম্বর ২০২৪ এ ২০.২০% আর সেপ্টেম্বর ২০২৫: ৩৫.৭৩%। নেট খেলাপি ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.৪০ শতাংশে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি কার্যত একটি সিস্টেমিক ব্যাংকিং সঙ্কটের লক্ষণ। এর প্রভাব পড়ছে নতুন ঋণ বিতরণে সঙ্কোচন, এসএমই ও শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া, সুদের হার কমলেও ঋণের চাহিদা তৈরি না হওয়ার দৃশ্যপটে।

মুদ্রানীতি : কড়াকড়ি ধরে রাখার খরচ : অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী : রিজার্ভ মানি (আরএম) এ নেতিবাচক প্রবণতা স্পষ্ট, ব্রড মানি প্রায় স্থবির অবস্থায়। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে থাকলেও, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবাহে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

পুঁজিবাজার : আস্থাহীনতার প্রতিচ্ছবি : ডিসেম্বর পর্যন্ত সূচকে দেখা যায়-ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ২.৯৯% এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ৩.৮৩%। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি, নীতিগত অনিশ্চয়তা ও বড় বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতি পুঁজিবাজারকে দুর্বল করে রেখেছে।

ঋণ ও বিনিয়োগ : বাস্তব খাতে ধীরগতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- এসএমই ঋণ বিতরণ ২০২৫ অর্থবছরে কমেছে আর শিল্প টার্ম লোনে বিতরণের চেয়ে আদায় বেশি। এর মানে নতুন শিল্প বিনিয়োগের তুলনায় পুরনো ঋণ আদায়ে জোর বেশি।

মূল্যস্ফীতি : নামছে, কিন্তু চাপ কমছে না : ২০২৫ সালের শেষ দিকে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি : ৯ শতাংশের নিচে আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট : ৮-৮.৫ শতাংশের মধ্যে। এটি ইতিবাচক প্রবণতা। তবে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ এখনো দৃশ্যমান।

প্রবৃদ্ধি : নিম্নমুখী বাস্তবতা : ২০২৫ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৯৭ শতাংশ, যা গত এক দশকের অন্যতম নি¤œ হার। এটি স্পষ্ট করে যে বাংলাদেশ এখন একটি সঙ্কট-পরবর্তী সমন্বয় অর্থনীতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

সংস্কার ছাড়া স্বস্তি টেকসই নয় : বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে রেমিট্যান্স ও নিয়ন্ত্রিত আমদানির ওপর ভর করে টিকে আছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের গভীর দুর্বলতা, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং নীতিগত সংস্কারের ঘাটতি অব্যাহত থাকলে এই স্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। অর্থনীতির সামনে এখন মূল প্রশ্ন- সংস্কার হবে, নাকি সঙ্কট জমতে জমতে বিস্ফোরিত হবে?