পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ভোক্তা ও সরকার

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ সঙ্কটের পেছনে ভারতীয় রফতানি নীতিও একটি বড় কারণ। প্রতি বছরই উৎসবের মৌসুমের আগে বা শস্য মৌসুমে ভারত হঠাৎ করে রফতানি শুল্ক বাড়ায় বা রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ যেহেতু মোট আমদানির বড় অংশ ভারত থেকে আনে, তাই ভারতীয় নীতির প্রভাব সরাসরি পড়ে দেশের বাজারে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় একটি বড় দুর্বলতা তৈরি করেছে।

শাহ আলম নূর
Printed Edition

দেশের পেঁয়াজের বাজার আবারো অস্থির। দাম বাড়ার প্রক্রিয়াটি এতটাই ধারাবাহিক ও সুপরিকল্পিত যে সাধারণ ভোক্তা যেমন জিম্মি হয়ে পড়েছেন, তেমনি নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের সামনে সরকারও কার্যত অসহায় হয়ে পড়ছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের এমন অভিযোগ দিন দিন আরো জোরালো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য ওঠানামা, সরবরাহ শৃঙ্খলে অস্বচ্ছতা ও অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট সব মিলিয়ে দেশের পেঁয়াজ বাজার যেন এক অচেনা চক্রের নিয়ন্ত্রণে। ফলে প্রতি বছর একই সময়ে দাম বাড়লেও কার্যকর প্রতিকার দেখা যায় না।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি দেশীয় পেঁয়াজ খুচরা পর্যায়ে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দু-তিন দিন আগেও ১১০-১২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। দেড় মাস আগে বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাওয়া যেত ৭০-৮০ টাকা দরে। সে হিসেবে মাত্র দেড় মাসে দেশীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতারা বলছেন, পেঁয়াজের দাম শুনে অনেক ক্রেতাই হতবাক হচ্ছেন। কেউ কেউ তর্কেও জড়াচ্ছেন। অনেকেই আবার না কিনে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ যে পরিমাণ কিনতে এসেছিলেন, তার অর্ধেক নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দেশের পেঁয়াজ বাজারে একটি সংগঠিত নেটওয়ার্ক বহুদিন ধরে কাজ করছে। কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে এমন সিন্ডিকেট গড়ে ওঠা নতুন নয়, কিন্তু পেঁয়াজে এটি যেন প্রতি বছরই আরো শক্তিশালী হচ্ছে। মূলত পাইকারি বাজারের কয়েকটি বড় আড়ত কেন্দ্র শ্যামবাজার, খাতুনগঞ্জ, সাতক্ষীরা, পাবনার সুজানগর এবং আমদানি নিয়ন্ত্রক কয়েকটি কোম্পানি একসাথে বাজারকে ‘ম্যানেজ’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত। তারা আগে থেকেই বাজারে ঘাটতির গুজব ছড়িয়ে খুচরাপর্যায়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ফলে ক্রেতারা বেশি দামে পণ্য কিনে নিতে বাধ্য হন।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ সঙ্কটের পেছনে ভারতীয় রফতানি নীতিও একটি বড় কারণ। প্রতি বছরই উৎসবের মৌসুমের আগে বা শস্য মৌসুমে ভারত হঠাৎ করে রফতানি শুল্ক বাড়ায় বা রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ যেহেতু মোট আমদানির বড় অংশ ভারত থেকে আনে, তাই ভারতীয় নীতির প্রভাব সরাসরি পড়ে দেশের বাজারে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় একটি বড় দুর্বলতা তৈরি করেছে।

সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সময় বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত দুই সপ্তাহে কয়েক দফা বাজার মনিটরিং, অভিযান ও সতর্কীকরণ নোটিশ দিলেও খুচরা বাজারে তার প্রভাব নেই। কারণ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তির নজির অতি কম। অভিযান চলাকালে কয়েকজন খুচরা বিক্রেতাকে জরিমানা করা হলেও পাইকারি পর্যায় বা আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনা বিরল। ফলে সিন্ডিকেট অপরিবর্তিত থাকে, আর দাম বাড়ার ধারা অব্যাহত থাকে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমে উৎপাদন, আমদানি ও গুদামজাতের তথ্য স্বচ্ছ করতে হবে। দেশের কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন হয় ২৫ লাখ থেকে ২৬ লাখ টন। অতিরিক্ত চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টন আমদানি করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে বাজার ও আমদানির হিসাব মিলছে না। উৎপাদন বাড়লেও কেন বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না তার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারে না। কৃষি বিভাগের অভিযোগ- মাঠপর্যায়ে উৎপাদনের তথ্য দিলেও বাণিজ্যপর্যায়ের ব্যবসায়ী নেটওয়ার্ক বাস্তব অবস্থা গোপন করে বাজারে সঙ্কটের চিত্র তৈরি করে।

ব্যবসায়ীরা অবশ্য সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তাদের দাবি, বাজারে মজুদে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা হয় না; বরং আমদানির খরচ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয় ও প্রতিবেশী দেশের রফতানি নীতির কারণে দাম বাড়ে। কিন্তু গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমদানি ব্যয় বাড়ার হার এবং দেশে ভোক্তাপর্যায়ের মূল্যবৃদ্ধির হারের মধ্যে বড় ধরনের অমিল রয়েছে; অর্থাৎ একই সময়ে আমদানির খরচ ১০ শতাংশ বাড়লেও খুচরা বাজারে দাম বাড়ছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। এটি বাজারে একাধিক স্তরে অতিরিক্ত মুনাফা নেয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

হঠাৎ পেঁয়াজের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ ক্রেতারা বিপাকে পড়েছেন। রাজধানীর একটি বাজারে কথা হলে বেসরকারি চাকরিজীবী রহিমা আক্তার বলেন, ‘প্রতি বছর একই সমস্যা। সরকার শুধু বলে বাজার নজরদারি করছে, কিন্তু আমরা তো কোনো সুবিধা পাই না। তিন-চার কেজি পেঁয়াজ কিনতেও ভয় লাগে। মনে হয় বাজার যেন কারো নিয়ন্ত্রণে নেই।

সরকারি পর্যায়ে দাবি করা হচ্ছে, দ্রুতই বিকল্প উৎস থেকে আমদানি বাড়ানো হবে। মিয়ানমার, তুরস্ক, চীন, পাকিস্তান থেকেও জরুরি ভিত্তিতে পেঁয়াজ আনার উদ্যোগ চলছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগ বরাবরের মতোই প্রতিক্রিয়াশীল, দীর্ঘমেয়াদি নয়। বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের দাম পরিবর্তন হলে বা কোনো দেশ হঠাৎ নীতি পরিবর্তন করলে বাংলাদেশ আবার বিপদে পড়বে।

বাজার বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি বাজারব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করে কোন আড়তে কত মজুদ রয়েছে এবং কোন পর্যায়ে পণ্যের সরবরাহ আটকে যাচ্ছে, তা রিয়েল টাইমে জানার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি আমদানিকারকদের হিসাব, গুদামজাতের অনুমতি, পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসা সব কিছুই কঠোর লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ দিকে বাজারে সিন্ডিকেট ইস্যু নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। অর্থনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ সবাই অভিযোগ করছেন, কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে মিশিয়ে বাজারকে জিম্মি করে রেখেছে। সরকারের ওপরও প্রশ্ন উঠছে বড় ব্যবসায়ীদের সাথে অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় কি কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সবাই চায় বাজার ঠিক হোক, কিন্তু বাস্তবে যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, তারা এতটাই শক্তিশালী যে সহজে হাত দেয়া যায় না।’

বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার চাইলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করে সিন্ডিকেট ভাঙা, মনোপলি ব্যবসার বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা এবং মূল্য কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে বাজার দ্রুতই স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে কি না; এ নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. জামাল উদ্দীন বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। আমদানির অনুমতি দিতে সরকারকে বাধ্য করতেই সিন্ডিকেট চক্র কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। অথচ এখনো এক লাখ টনেরও বেশি পুরনো পেঁয়াজ আছে।

বাজারে পেঁয়াজের কোনো সঙ্কট নেই জানিয়েছেন কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও। তিনি গত ২৬ নভেম্বর এক ব্রিফিংয়ে বলেন, কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানির জন্য আমাদের ওপর অনেক চাপ প্রয়োগ করেছে। তারা কোর্টেও গেছেন, যাতে আমরা পেঁয়াজ আমদানি করি। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকদের কথা চিন্তা করে পেঁয়াজ আমদানি করতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পেঁয়াজের নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করেছে, সেটি গ্রীষ্মকালীন। ওই পেঁয়াজটা বাজারে আসতে শুরু করেছে। আবার মুড়িকাটা পেঁয়াজও আসা শুরু হয়েছে। এ জন্য পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কৃষি উপদেষ্টা আরো বলেন, আমদানি করলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকরা একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিন্তু তারা ওই চাষের দিকে আর যাবে না। এ জন্য আমাদের সবসময় কৃষকদের দিকে তাকাতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ার সাথে সাথে সরকারের হাত-পা গুটিয়ে যাচ্ছে, আর সাধারণ মানুষ ক্রমাগত অতিরিক্ত দামের চাপে হাঁসফাঁস করছে। প্রতি বছর একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হলেও টেকসই সমাধান না হওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যেন অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে চলে গেছে। পরিস্থিতি এমন যে সরকার ও ভোক্তা উভয়েই কার্যত সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিকল্পিত ও কঠোর বাজার সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।