বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় সরকার

অর্থ উপদেষ্টার সাথে দেখা করে রিহ্যাব নেতৃবৃন্দের বিধান অব্যাহত রাখার দাবি

আবাসন ব্যবসায়ী সমিতি রিহ্যাবের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে আবাসন খাতে যেন কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা হয়।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা না রাখা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সরকার। সরকারের একটি প্রভাবশালী মহল চাচ্ছে আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা বিধান যেন পুরোপুরি তুলে দেয়া হয়। কিন্তু এখানে বাদ সেধেছে একটি বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এবং এতে মৌন সমর্থন জানাচ্ছেন এক শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। ফলে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা না রাখা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, আবাসন ব্যবসায়ী সমিতি রিহ্যাবের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে আবাসন খাতে যেন কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা হয়। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ৯ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল গতকাল সোমবার বিকেলে অর্থ উপদেষ্টার সাথে সচিবালয়ে দেখা করে এ অনুরোধ করেন বলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে। এ সময় তাদের সাথে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আবাসন ব্যবসায়ীরা অর্থ উপদেষ্টাকে বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে আবাসন খাতে ব্যবসায় অনেকটা মন্দা যাচ্ছে। অনেক প্লট এখনো অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে গত এক বছর ধরে এই খাতে ব্যবসা একেবারেই নাই বললেই চলে। রিহ্যাবের ব্যবসায়ীরা এখানে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তার কোনো রিটার্ন পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে সরকার যদি এ খাতে অপ্রদর্শিত (কালো টাকা) অর্থ বিনিয়োগ করার বিদ্যমান সুবিধা বাতিল করে দেয় তবে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তারা আরো বলেন, এ খাতে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন, তারাও বেকার হয়ে পড়বে। এবং এতে করে সমাজে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তাই সরকারের কাছে রিহ্যাব নেতারা অনুরোধ করেন-আগামী বাজেটে বিদ্যমান সুবিধা যেন প্রত্যাহার করে না নেয়া হয়।

সূত্র জানায়, রিহ্যাবের পক্ষ থেকে এই অনুরোধের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কোনো আশ^াস প্রদান করা হয়নি। তবে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদের সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সুযোগ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২ সেপ্টেম্বর এনবিআর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে সে সময় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত থাকলে তা নির্ধারিত হারে আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধানটি বহাল রাখা হয়। এর মধ্যে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর বাড়িয়ে কিছু কাটছাঁট করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলভেদে তিন থেকে পাঁচ গুণ কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতেই দেখায় দেয় বিপত্তি, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে সরকারের এই প্রস্তাবের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়।

অর্থ বিলে বলা হয়েছে, সরকারিভাবে নির্ধারিত এলাকা ভেদে ফ্ল্যাট বা ভবন কেনা এবং নির্মাণে কালো টাকা সাদা করতে হলে প্রতি বর্গফুটে নির্দিষ্ট হারে কর দিতে হবে। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশায় দুই হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবনের ক্ষেত্রে কর হবে প্রতি বর্গফুটে দুই হাজার টাকা। একই এলাকায় দুই হাজার বর্গফুটের কম আয়তনের ক্ষেত্রে কর নির্ধারিত হয়েছে ১৮০০ টাকা। ধানমন্ডি, উত্তরা, মহাখালী, লালমাটিয়া, বসুন্ধরা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কাওরানবাজারসহ অন্যান্য অভিজাত এলাকায় দুই হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবনের ক্ষেত্রে কর হবে ১৮০০ টাকা এবং অনধিক আয়তনের ক্ষেত্রে ১৫০০ টাকা।

অপর দিকে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাইরে সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোতে বড় ফ্ল্যাটের (১৫০০ বর্গফুটের বেশি) ক্ষেত্রে কর প্রতি বর্গফুটে ৭০০ টাকা এবং ছোট ফ্ল্যাটে (১৫০০ বর্গফুটের কম) কর ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

জেলা সদরের পৌর এলাকায় বড় ফ্ল্যাটের জন্য কর প্রতি বর্গফুটে ৩০০ টাকা এবং ছোট ফ্ল্যাটের জন্য ২৫০ টাকা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বড় ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে কর ১৫০ টাকা এবং ছোট ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা।

ভবন নির্মাণেও সুযোগ : শুধু অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনা নয়, ভবন নির্মাণেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ৫০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত কর দিয়ে এই সুবিধা নেয়া যাবে।

শর্তসাপেক্ষে বৈধতা : তবে দু’টি শর্ত উল্লেখযোগ্য: ১. এই অর্থ যদি অপরাধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়, তবে তা বৈধ করা যাবে না। ২. অর্থের উৎস বৈধ না হলে, আইনের এই ধারায় সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।

এ দিকে, জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত কর ব্যবস্থায় সরকার ব্যক্তি পর্যায়ে নির্ধারিত বিশেষ কর প্রদানের মাধ্যমে ভবন, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ রেখেছে, যদিও করের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। অতীতে এ ধরনের বিধান দেয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়নি। যদি কোনো সরকার অবৈধ আয়কে বৈধতা দিতে চায়, তবে তা কঠোরভাবে এককালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখার তীব্র সমালোচনা করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)। সংস্থাটি বলেছে, এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। টিআইবি বলে, ‘যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র সংস্কার বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একইসাথে, দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। করহার যা-ই হোক না কেন, এটি সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে যে অনুপার্জিত আয় অবৈধ হবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ একইসাথে বৈষম্যমূলক, কারণ এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।’

এ সমালোচনার প্রেক্ষাপটে অর্থ উপদেষ্টা গত ৩ জুন বাজেট-উত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সবাই যদি এই বিধান না চায় তবে সরকারও এ বিষয়টি বিবেচনা করবে।