একটি চরম অর্থনৈতিক ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রা শুরু করেছিল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এক বছর পেরিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন-প্রচেষ্টা শুধু সময়োচিত নয়, একইসাথে কৌশলী ও বাস্তবভিত্তিকও ছিল। একে ধরা যায়- একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে সম্ভাবনার ভবন গড়ার এক দুরূহ অথচ সাহসী প্রয়াস।
বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন মাত্রা : যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলী সমঝোতা : সরকারের শুরুর দিকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক অর্জন ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্ক হ্রাসবিষয়ক সমঝোতা। ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এই একক চুক্তি বাংলাদেশের তৈরী পোশাক, ওষুধ ও কৃষিপণ্যের রফতানিতে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সামষ্টিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধার : মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা : দুই অর্থবছর ধরে যেখানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছিল, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর মাত্র ৯ মাসেই তা ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। জুন ২০২৫-এ মূল্যস্ফীতির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৪৮ শতাংশ, যা গত ২৭ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। এটা শুধু একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক সাফল্য নয়; বরং সরকারের বাজার হস্তক্ষেপ নীতির বাস্তবিক ফলাফল।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্বিগুণের বেশি : ১৪ বিলিয়ন থেকে ৩২ বিলিয়নে
শুধু মূল্যস্ফীতিই নয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও সরকার দেখিয়েছে অভাবনীয় দক্ষতা। ১৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে শুরু করে এক বছরের ব্যবধানে তা উন্নীত হয়েছে ৩২ বিলিয়নে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বকেয়া কোম্পানি বিল মেটানো, সবই এর অন্তর্ভুক্ত।
আদানি ইস্যু ও লোডশেডিং সঙ্কটের জরুরি সমাধান
দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ভারতের আদানি গ্রুপ ১০০ কোটি ডলারের বিদ্যুৎ বকেয়া আদায়ের চাপ সৃষ্টি করে। হুমকি আসে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের। সরকার দ্রুততার সাথে এ বিল পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যার ফলে রমজানে লোডশেডিং-মুক্ত বাংলাদেশ দেখতে পায় নাগরিকরা।
বন্যা ও সীমান্ত রাজনীতি : ডুমুর বাঁধ খুলে বিপর্যয়
ত্রিপুরার ডুমুর বাঁধ হঠাৎ করে খুলে দিলে স্রোতের তোড়ে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল প্লাবিত হয়। লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। যদিও এই সঙ্কট ছিল প্রতিবেশী দেশের একতরফা জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার ফল, তবুও সরকার ও সামাজিক সংগঠনের সমন্বয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা সম্ভব হয়। এ ছিল প্রশাসনিক সক্ষমতার এক কঠিন পরীক্ষা।
ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ়তা
তথাকথিত ‘পতিত সরকারের’ গোপন সমর্থকেরা একের পর এক আন্দোলনের নামে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করে। আনসারদের কর্মসূচি, গার্মেন্টস খাতে ভাঙচুর, শিক্ষার্থীদের ‘অটোপাস’ আন্দোলন সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু সরকার এসব আন্দোলন মোকাবেলায় প্রয়োগ করে কঠোর ও কৌশলনির্ভর প্রশাসনিক পদক্ষেপ।
রেমিট্যান্সে রেকর্ড প্রবাহ : প্রতি মাসে ২৫০ কোটি ডলার
অর্থনীতির আরেকটি চাঙ্গা সূচক হিসেবে রেমিট্যান্স প্রবাহের কথা উল্লেখযোগ্য। গড়ে প্রতি মাসে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসছে। এর পেছনে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপগামী শ্রমবাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং হুন্ডি রোধে ডিজিটাল রেমিট্যান্স চ্যানেলের সম্প্রসারণ।
ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ সক্ষমতা
বিদায়ী অর্থবছরে সুদসহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের বেশি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এতে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক ভিত্তি শুধু মেরামত হয়নি, বরং সরকারের দায়বদ্ধতা আন্তর্জাতিক মহলেও দৃশ্যমান।
বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালুর সফলতা
গত ১৪ মে থেকে চালু হওয়া বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার দেশে মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়ক হয়েছে। এটা শুধু একটি আর্থিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং সরকারের সাহসী নীতিকৌশলের প্রতিফলন।
স্টারলিংক : ডিজিটাল বাংলাদেশের নতুন পর্ব
স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক চালুর মাধ্যমে সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ডিজিটাল কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করার পথে এগিয়েছে। এটি শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সাফল্যের রেখাচিত্র
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কিন্তু এক বছরের শুদ্ধাচার, কৌশলী নেতৃত্ব ও সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের দৃঢ়তা যে দেশকে একটি ভিন্ন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। স্তূপ থেকে টেনে তোলা এই অর্থনীতির পথে এখনো অনেক দূর যেতে হবে, কিন্তু যাত্রা শুরু হয়েছে এক নতুন আস্থার ভিত্তিতে।