কিছুক্ষণ পরপর সাইরেন বাজিয়ে ঢুকছে অ্যাম্বুলেন্স। সেই সাথে পেছনে ছুটছেন অভিভাবকরা। হয়তো তাদের সন্তান হতে পারে এই ভেবে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুললে সন্তানকে না পেয়ে আবারো ফিরে যাচ্ছেন। এমনই চিত্র দেখে গেছে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থীদের পরিবারের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। সন্তানদের শোকে পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ সন্তানের খোঁজ পেলেও অনেকে না পেয়ে ছোটাছুটি করেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে। দগ্ধদের অধিকাংশ শিশু।
এ ঘটনায় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আহাজারি করছেন আহতদের বাবা-মা, স্বজন ও সহপাঠীরা। ওয়ার্ডগুলোর সামনে বিলাপ করছেন তারা। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে দেখা গেছে অভিভাবকরা ছুটে এসে সন্তানকে খুঁজছেন, শুধু পোশাক দেখে শনাক্তের চেষ্টা করছেন। হাসপাতালের করিডোরে অসংখ্য অভিভাবক কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কেউ চিৎকার করছেন, কেউ হতবিহ্বল। কয়েক মিনিট পরপর ঢুকছে অ্যাম্বুলেন্স, আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে যাচ্ছে চার দিকের পরিবেশ।
সরেজমিন দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপর সাইরেন বাজিয়ে ঢুকছে অ্যাম্বুলেন্স। কারো কারো সাথে পরিবারের সদস্যরা থাকলেও অধিকাংশের সাথে ছিল না কেউ। কেউ খুঁজছেন সন্তান-স্বজন কারও প্রয়োজন অভিভাবক। রক্ত দেয়ার জন্য ছুটে এসেছেন অনেকেই। সেখানে প্রতিটি মানুষ হয়ে উঠেন স্বেচ্ছাসেবক। বার্ন ইনস্টিটিউট ঘিরে মানুষের অস্বাভাবিক দৌড়ঝাঁপ ও চোখে মুখে শোকের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। রাস্তা পরিষ্কার করতে সবাই কাজ করছেন। ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নেয়া, সেখান থেকে বেডে দেয়ার কাজে সহযোগিতা করছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক টিম। মাঝেমধ্যে মাইকে প্রয়োজনীয় ঘোষণা দেয়া হচ্ছে।
মেয়ের খোঁজে আবদুল কাদের তার ভাইসহ এসেছেন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। মেয়ে আফিয়া তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার খোঁজ পাচ্ছেন না। তৃতীয় শ্রেণীর সায়মা, পড়ত বাংলা ভার্সনে। তার খোঁজে এসেছেন তার বাবার এক সহকর্মী। মানবিকতার এক নজিরও দেখা গেল জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। সিরিয়াল পড়ে গেছে রক্তদানের লাইনে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নানা পেশার মানুষ এসেছেন স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে।
মাইলস্টোনে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সামিনের ভাই কান্নারত অবস্থায় বলেন, দুর্ঘটনার পর আমার ভাইকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সামিনের অবস্থা খুবই খারাপ, আইসিইউতের্ আছে। ডাক্তার বলেছে ৫০ শতাংশ বাঁচার সম্ভাবনা আছে।
তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী আফিফাকে খুঁজে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা। জরুরি বিভাগ ও বিভিন্ন ওয়ার্ডে না পেয়ে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। স্বজনরা সান্ত্বনা দিলেও কিছুতেই আফিফার মাকে থামানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি কিছুই চাই না, আমার সন্তানকে এনে দেন। আফিফাকে স্কুল থেকে আনার জন্য বাসা থেকে বের হই, তখনই শুনতে পাই স্কুলের মধ্যে বিমান আছড়ে পড়েছে। পরে গিয়ে দেখি অনেকেই পুড়ে গেছে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমার সন্তানকে পাইনি। পরে ছুটে আসি জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে; কিন্তু এখানেও পাচ্ছি না খোঁজ। সন্তানের খোঁজ মেলা ছাড়া যাবেন না বলে জানান তিনি।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরিয়ান হোসেন মামা বলেন, আমার ভাগনের বাবা নেই। তার মা অনেক কষ্ট করে তাকে পড়াশোনা করাত। কিন্তু আজকের ঘটনার পর সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। সারা শরীর ও মুখের কিছু অংশ পুড়ে গেছে আফিফের। বাঁচবে কি না বলতে পারছি না। আমার ছোট ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলে আরিয়ান আফিফ আগুনে আটকা পড়েছে। অনেক খোঁজার পর তাকে পাই। আমি বাংলাদেশে মেডিক্যালে গিয়ে দেখি তার শরীর পুড়ে গেছে। অবস্থা খারাপ হওয়ায় একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে বার্ন হাসপাতালে নিয়ে আসি। সাথে করে আরো দুইজন দগ্ধ শিক্ষার্থীকে নিয়ে আসি। কারণ তাদের অবস্থাও ছিল আশঙ্কাজনক। তাদের একজনেরও অভিভাবক ছিল না। পরে একজনের বাবার সাথে যোগাযোগ করতে পারলেও অন্যজনের পবিারকে জানাতে পারিনি। কারণ সেই শিক্ষার্থীর অবস্থা ছিল খুবই খারাপ।
দুর্ঘটনায় তৃতীয় শ্রেণী শিক্ষার্থী দগ্ধ বোরহান উদ্দিন বাপ্পির মা কান্না করতে করতে বলেন, আমার ছেলেকে দুপুরের খাবার দিয়ে বাসায় যাই। কারণ ক্লাস শেষে সে কোচিং করে যার জন্য যেতে কিছুটা দেরি হয়। বাসায় যেতেই এই খবর পাই। আমাকে একজন ফোন দিয়ে এসব ঘটনায় জানায়। সেখানে গিয়ে দেখি সব পুড়ে গেছে। তারপর আমি তাড়াতাড়ি করে স্কুলে এসে যা দেখেছি তা বর্ণনা করার মতো না। এরপর থেকে আমি আমার সন্তানকে আর দেখিনি। আমি জানিও না তার এখন কি অবস্থা। বর্তমানে সে আইসিউতে আছে। তার মুখ বেশি পুড়ে গেছে বলে জেনেছি।
আয়েশা বেগম বলেন, আমার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ক্লাস শেষে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। এখন ওর খোঁজ পাচ্ছি না। কোথাও নাম নেই, কেউ কিছু বলতে পারছে না। আমি কোথায় যাবো?
শিক্ষার্থীরা জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার হল নামের যে ভবনটিতে বিধ্বস্ত হওয়া বিমান আছড়ে পড়েছে, সেই ভবনে একটি কোচিং ক্লাস চলছিল। বিমানটি যখন বিধ্বস্ত হয় তার আগেই স্কুল ছুটি হয়ে যায়। তবে ভবনটিতে কোচিং ক্লাস চলছিল। এ ছাড়া সেখানে ছিল স্কুলের প্রিন্সিপালের রুম ও মিটিং রুম। ভবনটির প্রথম তলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম। এই ঘটনায় আহত হবে ১০০ জনেরও বেশি। আর নিহত প্রায় ৫০ জন। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর শরীর পুড়ে গেছে।
দেখা যায়, দলে দলে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ রক্ত দিতে আসছেন। তবে পজিটিভ রক্ত পর্যাপ্ত পাওয়া গেলেও সংকট রয়েছে নেগেটিভ রক্তের। এ অবস্থায় মেডিক্যালের ভেতরে এবং বাইরে মাইকিং করা হচ্ছে রক্তের জন্য। পাশাপাশি মেডিক্যালের বাইরে ট্রাফিক পুলিশ সদস্য সাঈদও তার হ্যান্ড-মাইক দিয়ে নেগেটিভ রক্তের জন্য মাইকিং করছেন। আহতদের জন্য রক্তের সংগ্রহে কাজ করছেন শিক্ষার্থী-সাধারণ মানুষ। এ কাজে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। দুর্ঘটনার স্থানের পাশেই তারা মাইকিং করে রক্ত দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটেও বহু আহত-দগ্ধদের নেয়া হয়েছে। আইএসপিআরের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছে ৭০ জন। সেখানে দুইজনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলছেন, ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগের অবস্থা আশঙ্কাজনক।