বিশিষ্ট লেখক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেছেন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর পূর্ণাঙ্গ বিচার কিছু হচ্ছে, আরো দ্রুত করা দরকার যেগুলো হচ্ছে না। আবার কোনো রাজনৈতিক দল অনুশোচনাও করছে না। কোনো শাসক তার অপরাধের দায় স্বীকার করছে না। বরং তারা একবার বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে, আবার পরবর্তীতে বলছে আমরা বিচারের নামে অবিচারের শিকার হয়েছি, তারা আবার প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, প্রতিশোধ নিচ্ছে। এই যে রাজনৈতিক সহিংসতা, অনুশোচনাহীন প্রতিশোধ এমন এক দুষ্টু চক্রের মধ্যে থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, হাসিনার বিরুদ্ধে একটা মামলার রায় হলো, তার বিরুদ্ধে মামলা আছে ৫৮৩টি। যত মামলা চলবে ততদিন কি আমরা আওয়ামী লীগের জ্বালাও পোড়াও হরতালের মধ্যে থাকব। অতীতেও আমরা এমন হরতাল সহিংসতার মুখে পড়েছি। তার মানে এ থেকে আমাদের আর নিষ্কৃতি নেই। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তখনো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে। পরবর্তী সরকারের আমলেও রাজনৈতিক খুনাখুনি হয়েছে। ’৯০ সালেও অনেক ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০২৪ সালেও হলো। এই প্রত্যেকটা পর্যায়ে রিকনসিলিয়েশন নেই, অনুশোচনা নেই।
আলতাফ পারভেজ নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সমাজের বিভিন্ন মহল, বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের ভেতর যে শক্তিগুলোকে একত্রিত করে দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পরে রিকনসিলিয়েশন কমিটি করে ভালো ফল পেয়েছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রথম দুই সপ্তাহে কিন্তু এ প্রসঙ্গটা উঠেছিল যে রিকনসিলিয়েশন কমিশন হবে, আমরা রিকনসিলিয়েশনের জন্য চেষ্টা করব। এটা এখন আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই নেয়া হলো না। ফলে সহিংসতা এবং প্রতিশোধ এর একটা চক্রে বাংলাদেশ পড়ে গেল, পড়েছিল এবং পড়ে থাকবেও। এটা নাগরিকদের পক্ষ থেকে উদ্বেগের ব্যাপার।
নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনের মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?
আলতাফ পারভেজ : জুলাই আন্দোলন বড় মাত্রায় ঘটেছে এবং মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। ব্যতিক্রমীও ছিল, কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে হয়নি। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, পেশার মানুষ বিশেষ করে তরুণদের নেতৃত্বে হয়েছে। সেই কারণে বিশ্বজুড়ে এটা বিরল ঘটনাই ছিল, আবার এখানে প্রত্যাশার অনেক আধিক্য ছিল, সেই কারণে বিগত ১৫ মাস একটা অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এবং আমার ধারণা এরকম অস্থিরতা আরো অনেক দিন চলবে। কারণ কোনো রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোনো কর্মসূচির অধীনে এ আন্দোলন হয়নি। আবার বিপুল রাজনৈতিক প্রত্যাশাও ছিল মানে এ দুটোতে কাঠামোগত এক ধরনের স্ববিরোধিতা আছে, সেই কারণে অস্থিরতা অনেক দিন চলবে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলো এই ১৫ মাসে মানুষের ওই আকাক্সক্ষাকে একটা সুচিন্তিত বা সুপরিকল্পিত পথে কিন্তু এগিয়ে নিতে পারেনি। গণ-অভ্যুত্থানের পর যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারতো জনপ্রিয় ও বৈধ অবশ্যই, কিন্তু একটা অনির্বাচিত সরকার। সেই সরকারের কাছেও মানুষের বিপুল প্রত্যাশা ছিল। ছাত্রনেতারাই সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের অনেকাংশ বাছাই করেছে। প্রধান উপদেষ্টা তার উপদেষ্টা পরিষদ বাছাইয়ে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু এই উপদেষ্টা পরিষদ গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারেনি। দুই ধরনের পারফরম্যান্সের ব্যাপার ছিল। একটা হলো সাধারণ স্বাভাবিক সরকার যে ধরনের কাজ করে অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসন পরিচালনা, উন্নয়ন এগিয়ে নেয়া সেটাতো এ সরকারের একটা প্রয়োজন ছিল। আবার রিফর্ম, সংস্কারের ব্যাপারগুলো এগিয়ে নেয়ার ব্যাপার ছিল। দুটোর ক্ষেত্রেই ঘাটতি পড়েছে। স্বাভাবিক সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যে ধরনের ভূমিকা রাখে, অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু সেভাবে পারেনি।
শুভ উদ্যোগ হিসেবে সরকার শুরুতে ১১টা সংস্কার কমিশন গঠন করা ছাড়াও অর্থনীতি নিয়ে দু’টি টাস্কফোর্স গঠিত হয়। এসব কমিশনে সদস্য হিসেবে এক দেড় শ’ বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞ যুক্ত ছিলেন। ১৩টি কমিশনের প্রস্তাবনা জমা দেয়া হলেও মাত্র ছয়টি কমিশন নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সাতটি কমিশনের রিপোর্ট বা সুপারিশগুলো বাদ পড়ে বা প্রতিবেদনেই থেকে যায়। পুলিশ ও নারী সংস্কার, শ্রম বা প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন জুলাই আন্দোলনের প্রধান দিক ছিল। জুলাই অভুত্থানে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের বিরাট ক্ষোভ ছিল, পুলিশের সংস্কার ও ঔপনিবেশিক প্রশাসন সংস্কারের প্রায় প্রধান বিষয় ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানে শ্রমিকরা বিপুলভাবে অংশ নিয়েছে, তাদের জীবন যাপনের পরিবর্তনের আশা থেকেই তো নিয়েছে, বিপুল মাত্রায় নারীরা অংশ নিয়ে চেয়েছে যে তাদের জীবনে কিছুটা পরিবর্তন ঘটুক। কিন্তু এই কমিশনের রিপোর্টগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে শুরু থেকেই বাদ পড়ে যায়। ফলে বাকি ছয়টি কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব থেকে জুলাই সনদ তৈরি হয়। তাতেও ঐকমত্য হয়েছে মাত্র ৩০টি বিষয়। রাজনীতিবিদরা এসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছালেন এবং একটা ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করলেন তা আকাক্সক্ষার তুলনায় অতি সামান্য। জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণ হবে যদি এগুলো গণভোটে পাস হয়।
অভ্যুত্থানকালে যে জাতীয় ঐকমত্য ছিল, শুভ ভবিষ্যতের লক্ষ্যে রাজনীতিবিদরা যে পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেটা ভেঙে গেছে। জাতীয় ঐকমত্য বলে এখন আর কিছু নেই। তারা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি, তিক্ত বিবৃতি আদান প্রদান, রাজনৈতিক কর্মসূচি পর্যন্ত পালন করছেন। জুলাই আকাক্সক্ষা নিয়ে অস্থিরতার কারণ এগুলোই।
নয়া দিগন্ত : দেশকে সুস্থির করে এগোবার গন্তব্য কোথায়?
আলতাফ পারভেজ : দেশে মানুষের চাওয়া এখন ন্যূনতম। শান্তির লক্ষ্যে এবং বাস্তব প্রয়োজনের জায়গা থেকে চাওয়া আপাতত একটা নির্বাচন। মানুষ ধরে নিয়েছে এখানে আর প্রত্যাশা আপাতত পূরণ হচ্ছে না। কিছু পাচ্ছি না এখন নির্বাচন হলে পরবর্তী সরকার যদি জুলাইয়ের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করে করবে, তা না হলে অন্য দলগুলো দাবি দাওয়া তুলবে।
নয়া দিগন্ত : এ ছাড়া গণতন্ত্রে আর পথ কোথায়?
আলতাফ পারভেজ : না নেই। জুলাই আন্দোলনের সাথে ঊনসত্তরের একটা মিল হচ্ছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতৃত্বের সরে যাওয়া। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে তিনি অংশ নেননি। এবারো দেখছি যারা জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো মূলত। পাশে ছিল শ্রমিক- জনতা। কিন্তু রাজনীতি ও নির্বাচনের নেতৃত্বে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা আন্দোলনে ছিল কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়নি। কিন্তু যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারা ইতোমধ্যে পিছিয়ে পড়েছে। সে জন্য নির্বাচনের পরও জুলাই আকাক্সক্ষা কতটুকু পূরণ হবে সেটা নিয়ে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। তারপরও মানুষ আশা করছে।
নয়া দিগন্ত : রাজনীতিবিদরা যদি রাজনীতিতে ব্যর্থ হন তাহলে এই শূন্যস্থান পূরণে তো একটা ভয়ঙ্কর ঝুঁকি থাকে?
আলতাফ পারভেজ : সেতো বটেই। স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর হলো, শুরুটা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে, হাজার হাজার মানুষ শহীদ হয়েছে, প্রতিটা গ্রাম বিপর্যস্ত হয়েছে, তারপও নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থান হতে হলো কেন? ২০২৪-এ আবার গণ-অভ্যুত্থান হতে হলো? কারণ রাজনীতিবিদরাতো ব্যর্থই হয়েছেন বারবার। এই ব্যর্থতার কারণ রাজনীতিবিদরা দেশের মূল সমস্যা শনাক্ত কিংবা সমাধান করতে পারেননি। সমস্যাটা হলো আমরা এখনো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় রয়ে গেছি। আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ এ একবার, ১৯৭১ এ একবার, এরপর দু’টি গণ-অভ্যুত্থান কিন্তু আমাদের পুলিশি ও প্রশাসনব্যবস্থা ১৭৯২ সালের সেই কর্নওয়ালিসের করা ব্যবস্থাই রয়ে গেছে। ওরা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ব্যবস্থা করেছিল। বঞ্চনা ও শোষণের ভেতর দাবিয়ে রাখার জন্য। আমাদের রাজনীতিবিদরা চাচ্ছেন সেই ব্যবস্থাটা রেখে এগোতে। এটাই জনগণের আকাক্সক্ষার সাথে রাজনীতিবিদদের আচরণে বিরাট ব্যবধান।
নয়া দিগন্ত : মাঝখান থেকে এক বিরাট অলিগার্ক শ্রেণী, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যাদের লক্ষ্যই দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে মূলধন পাচার করা, ব্যাংক লুটপাট করা- চ্যালেঞ্জ তো বেড়েছে।
আলতাফ পারভেজ : চ্যালেঞ্জ বেশি, বঞ্চনা আরো বিপুল, বিদেশী প্রভুদের হাতে নেই কেবল, বিদেশী প্রভুদের আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি একটা লুটেরা বিজনেস সিন্ডিকেট পেয়েছি, লুটেরা ব্যবসায়ী সমাজ পেয়েছি এবং সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে তো অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থার ওপর, এখানে উৎপাদন ও সম্পদের বণ্টনের অবস্থা এমন যে ২৮ ভাগ মানুষ এখন দরিদ্র। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও। দুই ডলারের নিচেই তাদের আয় রোজগার। তাদের প্রশাসনে অভিগম্যতা নেই, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যেও নেই। এটা এক অমানবিক জীবন ও পৃথিবীতে মানুষের অধিকার ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের যেসব সুযোগ আছে তার সবগুলো সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে।
নয়া দিগন্ত : আমেরিকার সিনেটর বার্নি স্যান্ডারস তো বলছেন ৯৯ ভাগের সম্পদ কুক্ষিগত করে আছে বা চলে যাচ্ছে এক ভাগ মার্কিনিদের হাতে। আমরা আমেরিকাকে উন্নত দেশ বলি ও গণতন্ত্রের জন্য আমাদের এত আকাক্সক্ষা তো সেখানেও তো এত অব্যবস্থা।
আলতাফ পারভেজ : আমেরিকা ও বাংলাদেশের উৎপাদন ধরন পুঁজিতান্ত্রিক। বাংলাদেশে সবচেয়ে ওপরে যে দশভাগ ধনী মানুষের হাতে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ৪১ ভাগ। সবচেয়ে নিচে যে ১০ ভাগ দরিদ্র মানুষ তাদের হাতে জাতীয় আয়ের ১ দশমিক ৩ ভাগ মাত্র। চরম একটা ব্যবধান চলছে।
নয়া দিগন্ত : বছরে ২৬ লাখ তরুণ কর্মসংস্থানের বাজারে আসছে।
আলতাফ পারভেজ : একটা নীরব অর্থনৈতিক গণহত্যা চলছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর চারদিকে জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা, শোরগোল, কাগজগুলো, মিডিয়া, টিভি সব- এগুলো নিয়ে আলোচনা করছে। এই সময়ে উত্তরবঙ্গে আলুচাষিরা যেভাবে মার খেলেন উৎপাদন খরচ উঠাতে না পেরে, কোল্ড স্টোরেজে এক কেজি আলু রাখার খরচ ১২.৫০ টাকা। কিন্তু এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ২৪ টাকা। হাজার হাজার আলুচাষি মার খাচ্ছে। পেঁয়াজচাষিরা বিভিন্ন সময় মার খায়। শীত এসেছে, কদিন পর সবজির দাম পড়ে যাবে। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো সমাধান কোনো সরকার তো বটেই এ সরকারও করল না। মানুষের শঙ্কা আগামী সরকারও করবে না।
নয়া দিগন্ত : বন্দরে তো বিশাল বিনিয়োগ হয়ে গেল।
আলতাফ পারভেজ : বিনিয়োগের কথা আমরা সারা জীবন শুনে আসছি, সব সরকারই বিনিয়োগের গল্প শুনিয়ে আসছে, বিগত সরকারের আমলে গণ-অভ্যুত্থানকারী তরুণদের একটা দাবিই ছিল বা রাজনৈতিক দলগুলো বলত যে সরকার যখন কোনো চুক্তি করবে তখন তা যেন পার্লামেন্টে আলোচনা হয়। চুক্তির বিষয়বস্তু যেন প্রকাশ করা হয়। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কোনো কোনো উপদেষ্টা অতীতে এসব দাবি তুলেছেন। চুক্তিটি জাতীয় স্বার্থবিরোধী হচ্ছে কি হচ্ছে না। আদানির সাথে বিদ্যুৎ চুক্তিতো এখন তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেদিন রায় হলো যে মুহূর্তে সেদিন বেলা ১১টায় বন্দরে বিনিয়োগ চুক্তির কথা প্রকাশ করা হলো। যাতে চুক্তি নিয়ে আলোচনা না হয়। এ চুক্তিতে কী আছে সাধারণ মানুষ জানে না। বন্দর ব্যবহার করবে ব্যবসায়ীরা, আমদানি রফতানিকারকরাও জানে না এ চুক্তিতে কী আছে। তাদেরকে এ চুক্তির বিষয়বস্তু ফেস করতে হবে। যে মাশুল বৃদ্ধি করা হয়েছে তা ব্যবসায়ীরা আমাদের মতো ভোক্তাদের কাছ থেকেই আদায় করবে।
নয়া দিগন্ত : ভূকৌশলগত স্বার্থ বা দু’টি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে। একসময় বলা হতো ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর মতো।
আলতাফ পারভেজ : দেখুন গত ১৫ বছর আমাদের বিদেশনীতি ব্যর্থতায় ভরা ছিল। ভারতের দিকে বিদেশনীতি হেলে পড়েছিল। এটা ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না। উইন উইন-ধর্মী ছিল না। এই কাল, এই যুগটা এমন এখানে প্রত্যেক দেশ তার জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় তার পররাষ্ট্রনীতিকে সাজায়। আমাদেরও তাই করতে হবে। কোনো দেশের বিরুদ্ধে লাগার কিছু নেই, কোনো দেশের দিকে হেলে যাওয়া ঠিক হবে না। ভারত আমাদের সীমান্তের তিন দিকে, পৃথিবীর চতুর্থ বড় অর্থনীতির দেশ, আবার একটু দূরে ও কাছাকাছি আছে চীন। চীন উদীয়মান শক্তি বিশ্ব অর্থনীতিতে। আমাদের দেশে চীনের ভূমিকা আছে। চীনকে আমাদের দরকার। আবার ভারতের ভূমিকাকেও অগ্রাহ্য করতে পারব না। কারণ ভারতের সাথে আমাদের প্রচুর দ্বিপক্ষীয় বিষয় আছে।
নয়া দিগন্ত : দু’টি দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে নতজানু অবস্থান নেয় এমন অভিযোগ রয়েছে।
আলতাফ পারভেজ : হ্যাঁ, দুটো দেশের জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কতো লাগবেই কিন্তু দুটো দেশের সরকারের সাথে সরকারেরও সম্পর্ক লাগবে। ভাটির দেশ হিসেবে ভারতের ৫০টি নদীর পানিতে আমাদের হিস্যা আদায় দরকার। এই পানির আলোচনা তো সরকারকেই করতে হবে। সেই আলোচনা নিশ্চিত করতে হলে জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক লাগবে। সীমান্ত ও সীমান্ত বাণিজ্য রয়েছে। সুসম্পর্ক না থাকলেও দুই দেশের মানুষ ও প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অহেতুক ভারতবিরোধী বা ভারতকেও বাংলাদেশকে শত্রু ভাবার কোনো ব্যাপার নেই। আমাদের দেশে কী ধরনের সরকার আসবে, কী ধরনের সরকার যাবে ভারতের এটা বিবেচ্য হতে পারে না। ভারতে কী ধরনের সরকার হবে এটা বাংলাদেশের বিবেচ্য নয়। পরস্পরের স্বার্থকে পরস্পর বিবেচনা করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন কিভাবে, তারা তো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করছে না।
আলতাফ পারভেজ : ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হওয়ার আগে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আমরা তেমন কোনো মনোযোগ দেইনি। এত বড় প্রতিবেশী হলেও মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্য অতি নগণ্য। আমদানি ও রফতানির জন্য খুঁজি ইউরোপ আমেরিকাকে। জাপান মানে দূর-দূরান্তের দেশকে। ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা- এই অঞ্চলেও যে আমাদের বাণিজ্য হতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দেয়নি। মিয়ানমারকে নিয়ে ভাবতে বসেছি রোহিঙ্গারা চলে আসার পর, রোহিঙ্গা স্বার্থ দ্বারা মিয়ানমারের সাথে যাবতীয় বিষয় চালিত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের সাথে দু’টি পৃথক পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা উচিত। বাংলাদেশের স্বার্থ এবং দ্বিতীয়ত রোহিঙ্গাদের স্বার্থ। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে এটা বাংলাদেশের জন্য জরুরি কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট একমাত্র গুরুত্ব দেয়ায় আমাদের সাথে দেশটির অন্যান্য স্বার্থ এগোচ্ছে না। আরাকানসহ বার্মা একসময় বাংলার সাথেই ছিল। রেঙ্গুনে বিপুল বাংলাভাষী মানুষ ছিল। নোয়াখালী, চট্টগ্রামের বেশির ভাগ মানুষ রেঙ্গুনেই যাওয়া আসা করেছে, ব্যবসা করেছে। কিন্তু এই কালে ২০২৫ সালে কল্পনা করুন রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বাংলাদেশী ছাত্র নেই। কিংবা ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বার্মার কোনো ছাত্র নেই। মিয়ানমারে বেশি মানুষ বেড়াতেও যায় না। দূর-দূরান্তের দেশে যায়। মিয়ানমারের ভেতরে বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়নি, আবার স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই। ওরা আমাদের সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা, বিরক্তি, হতাশা, ক্ষোভ নিয়ে আছে। যা সম্পূর্ণ অমূলক। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে আলোচনার প্রথমেই এই ইস্যু উঠার পর বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও সামাজিক সম্পর্কের আলোচনা আর আসেই না। অবশ্যই রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় কিন্তু মিয়ানমারের সাথে অন্যান্য সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখতে হবে।



