ঘাতক হয়ে উঠেছে ব্যাটারি রিকশা

আব্দুল কাইয়ুম
Printed Edition

রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় মোটরসাইকেলে যাচ্ছেলিন আব্দুল্লাহ আল নোমান ও পাভেল। বনশ্রীর এফ ব্লক সড়কে আসতেই একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ধাক্কা দিলে মোটরসাইকেল চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান। এ সময় মিয়ামি নামক একটি বাস এসে চাপা দিলে ঘটনাস্থলে মারা যান আব্দুল্লাহ আল মামুন। মো: পাভেলকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফরাজী হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় ঘাতক বাসটি আটক করা হলেও পালিয়ে গেছে বাসের চালক ও হেলপার। এ দিকে আটক করা যায়নি অটোরিকশা চালককে।

শুধু আব্দুল্লাহ আল নোমান ও মো: পাভেল নয়, এমন ঘটনার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌড়াত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে, এগুলো কোনো আইনের তোয়াক্কা করছে না। এসব বাহনের বেপরোয়া চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ভোগান্তি, ঘটছে দুর্ঘটনা। এমনকি এসব দুর্ঘটনায় কখনো কখনো ঝরছে প্রাণ। ঢাকার মূল সড়কও এখন তাদের দখলে। ব্যাটারিচালিত রিকশার এ নৈরাজ্য ঠেকাতে কিছু নীতিমালা প্রণয়নসহ এগুলোর উৎপাদন ও আমদানি বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইনকে বৃদ্ধ আঙুল দেখিয়ে মূল সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব বাহন। কোনো সিগন্যাল না মেনে যেখানে-সেখানে থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করছে। এতে বাড়ছে জনভোগান্তি, সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এমনকি দ্রুত গতির যানবাহনকেও ওভারটেক করতে পিছপা হয় না এসব বাহন। পুরনো প্যাডেলচালিত রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে যান্ত্রিক করা হচ্ছে। বুয়েটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানের ঢাকায় প্রায় ৫০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, গত মার্চ মাসে ৯১০টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। তার মধ্যে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক ও পাঁচ দশমিক ১৬ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা সড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এ ছাড়াও ২০২৪ সালে এ দুর্ঘটনায় যানবাহনের ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। দুর্ঘটনায় সংগঠিত যানবাহনের দুই দশমিক শূণ্য নয় শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক ও শূণ্য দশমিক ১৮ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা সড়কে দুর্ঘটনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ১০ বছরে নতুন করে ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রাস্তায় নামার পাশাপাশি ছোট যানবাহন অবাধে বৃদ্ধি ও এসব যানবাহন সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ভয়াবহভাবে বাড়ছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যানের ছিল ১১৯ জন। যা মোট দুর্ঘটনার ১৯ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল। এ ছাড়াও বাইসাইকেল ও রিকশা আরোহী ১১ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় যানবাহনের মধ্যে এসব বাহন সম্পৃক্ত ছিল ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্রে দেখা যায়, থ্রি-হুইলার যাত্রী ১৩৯২ জন, বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা আরোহী ১৯৬ জন নিহত হয়েছেন। নগরবাসীর অভিযোগ, প্রতিদিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে অভিযান চালালেও তা কাজে আসছে না। এ ধরনের রিকশা বন্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান চালায় ঠিকই; কিন্তু কিছু দিন পর আবারো নতুন করে তারা রাস্তায় নামে। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কয়েক দফা অভিযান চালালেও থেমে নেই অবৈধ এসব বাহনের দৌরাত্ম্য। এ দিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দল রিকশার একটি নকশা তৈরি করেছে। এই নকশার রিকশা হবে সাধারণ রিকশার চেয়ে অনেক নিরাপদ। অবশ্য এটি তৈরিতে বর্তমান ব্যাটারিচালিত রিকশার সমান খরচ পড়বে। এটির গতি হবে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। আর এর কাঠামোগত কারণে দুর্ঘটনা তুলনামূক কম হবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানীর মূল সড়কের চেয়ে অলিগলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বেশি। সুযোগ পেলে মূল সড়কেও দাপিয়ে বেড়ায় এসব রিকশা। রাজধানীর প্রায় সর্বত্র ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল রয়েছে। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেকে আহত হচ্ছেন, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো: হাদিউজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো রাজধানীর জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বাহনের জন্য নীতিমালা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বুয়েট এই বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে একটি বাহন তৈরি করেছে যা এগুলো থেকে অনেকটা নিরাপদ। তা ছাড়া পরিবহন ব্যয়ও ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর চেয়ে কম। বুয়েটের তৈরি বাহনে ব্রেক পদ্ধতি ভালো হওয়ার কারণে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম। এই বাহনের সর্বোচ্চ গতি হবে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। তবে এর ফলেও রাজধানীতে ছোট যানবাহনের পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। ফলে জনদুর্ভোগ থেকে যাবে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানের ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর কাঠামো বিজ্ঞানসম্মত নয়। যার ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। প্যাডেলচালিত রিকশার মধ্যে ব্যাটারি লাগিয়ে চালানো মানে ঝুঁকি তৈরি করা। যারা এসবের দায়িত্বে আছেন তাদের আরো কৌশলী হতে হবে। আর যেভাবেই হোক তাদের মূল সড়ক থেকে সরাতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা যেন আর জন্ম হতে না পারে সে জন্য উৎপাদন ও আমদানিও বন্ধ করতে হবে।