মিয়ানমারের সাথে প্রক্সিযুদ্ধে জড়াবে না বাংলাদেশ

বিইউপি ও এএফডির যৌথ সেমিনারে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা

“এটি কোনো করিডোর নয়। আমরা শুধু মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে একটি ‘চ্যানেল’ গঠন নিয়ে আলোচনা করেছি। করিডোর আর চ্যানেল এক বিষয় নয়।”

কূটনৈতিক প্রতিবেদক
Printed Edition
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য অগ্রাধিকার বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য অগ্রাধিকার বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান |সংগৃহীত

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য অগ্রাধিকার বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান বলেছেন, মানবিক করিডোরের নামে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে মিয়ানমারের সাথে কোনো প্রক্সি যুদ্ধে বাংলাদেশ জড়াবে না। এটা নিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা নিছকই অপতথ্য ও গুজব।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশটিতে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক, এমন কিছুই বাংলাদেশ করবে না। এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে আশ্বাস্ত করা হয়েছে।

গতকাল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের (এএফডি) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন : আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ও ভবিষ্যৎ’ বিষয়ক এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

‘মানবিক করিডোর’ ইস্যুতে সাম্প্রতিক বিতর্ক প্রসঙ্গে খলিলুর রহমান বলেন, এটি কোনো করিডোর নয়। আমরা শুধু মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে একটি ‘চ্যানেল’ গঠন নিয়ে আলোচনা করেছি। করিডোর আর চ্যানেল এক বিষয় নয়। মানবিক চ্যানেল বাস্তবায়িত হলে তা জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে এবং শুধু ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা পৌঁছাতে ব্যবহৃত হবে।

ড. খলিল আরো বলেন, ‘রাখাইনে কোনো ধরনের মানবিক তৎপরতা পরিচালনার জন্য উভয় পক্ষের সম্মতি আবশ্যক।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে-কিভাবে যুদ্ধবিরতি হবে, যখন তাতমাদাও (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) এখনো বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সাথে আলোচনা করেছি। তারা বলেছে, যদি আরাকান আর্মি স্থল অভিযান বন্ধ করে, তবে তারা বিমান হামলা চালাবে না। এরপর সংঘর্ষ হয়নি, বিমান হামলাও হয়নি। যুদ্ধে একটি বিরতি এসেছে, এটাই এ পর্যন্ত অর্জন।’

যুদ্ধে চলমান বিরতি স্থায়ী হলে শান্তি ও প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনার পথ তৈরি হতে পারে বলে মন্তব্য করে। তিনি বলেন, ‘আমি এটাকে শান্তি বলছি না। কিন্তু যুদ্ধ না থাকাটা ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারলে শান্তির একটা সূচনা হতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে।’ তবে রাখাইনের বর্তমান প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি না হলে সেখানে টেকসই শান্তি আনা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘আরাকান আর্মি ও ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের কোনো অবস্থান নেই, এটি একপ্রকার জাতিগত নিধনের চিত্র।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে বিষয়টি মিয়ানমারকে জানিয়েছে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। আমরা মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া জানতে অপেক্ষা করছি।’

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যাচাইয়ের জন্য রোহিঙ্গাদের ছয়টি তালিকা দিয়েছে এবং মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার জনের যাচাইকৃত একটি তালিকা পেয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রতিবেশী দেশের সংবাদমাধ্যমে রাখাইনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রক্সি যুদ্ধের’ বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘৮ এপ্রিল আমি একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি এটা অযৌক্তিক। এমনকি কক্সবাজারে ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির সাথে একটি সাধারণ বৈঠককেও ‘গোপন সামরিক বৈঠক’ বলে উপস্থাপন করা হয়েছে।

খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছি যে আমরা তাদের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি।’

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘এ ধরনের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জটিল এবং এগুলো ধৈর্য ও বিচক্ষণতা দিয়ে পরিচালিত করা উচিত, জনমত বা গুজবে প্রভাবিত হয়ে নয়।’ তিনি বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আত্তীকরণ করতে চাই না। সেটি করলে জাতিগত নিধনকে বৈধতা দেয়া হবে- এটি আমাদের ‘রেড লাইন’। তিনি আরো বলেন, অতীতে কূটনীতি ও সামরিক চাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলা করা হয়েছে। এখন একটি টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতা নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গারা ফিরবে। সহজ হবে না, কিন্তু আমরা এটা করব, বলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।

অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পরই তারা ফিরে যাবে। মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ, দেশটির অভ্যন্তরে বিভক্তি, বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তার অব্যাহত অনুপস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা এখন সুদূর পরাহত। আমরা এখনো এই সঙ্কটের কার্যকর সমাধান খুঁজে পাইনি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দু’টি দিক রয়েছে। একটি হলো অধিকার, অন্যটি নিরাপত্তা। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত না হলে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে না। আমরাও কোনো অযৌক্তিক প্রত্যাশায় নেই। যে নির্যাতন থেকে তারা বাঁচতে চেয়েছিল, আমরা কি তাদের সেই জায়গায় ফেরত পাঠাব?

তিনি বলেন, মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এ বিষয়ে বাস্তব কোনো ফল আসবে না। দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ওপর বাংলাদেশের প্রাথমিক নির্ভরতা ছিল। আমিসহ অনেকেই সতর্ক করেছিলাম, এই ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। বছরের পর বছর ধরে চলা দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়াটি নিরর্থক হলো। একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, মিয়ানমারে অবশ্যই বাস্তব পরিবর্তন আসতে হবে। সেই পরিবর্তন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হতে হবে। যদিও এটি কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ঐক্যবদ্ধ না হলে এটা সম্ভব হবে না। অন্যান্য বৈশ্বিক সঙ্ঘাতের মধ্যে রোহিঙ্গা সঙ্কটের ওপর থেকে যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ সরে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য একটি রোডম্যাপ থাকা দরকার।

মিয়ানমারে কখনো গণতন্ত্র ছিল না উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সু চির অধীনেও মিয়ানমারে একটি আধা সামরিক শাসনব্যবস্থা কাজ করেছিল। আমরা মিয়ানমারে এখন যা দেখছি, তা হলো পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ। মিয়ানমারের এখন মূল অংশীদার হলো সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি এবং জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি)। যেকোনো স্থায়ী সমাধানে এই তিন পক্ষকেই যুক্ত হতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ করে আরাকান আর্মিকে যুক্ত হতে হবে, যারা এখন রাখাইন নিয়ন্ত্রণ করছে।