আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তফসিল ঘোষণার পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে এখন একটিই শব্দ- মেরুকরণ। কিন্তু এই মেরুকরণ একমুখী বা সরলরৈখিক নয়। তফসিল ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনীতি কেবল প্রকাশ্য মেরুকরণে সীমাবদ্ধ নেই। দেশ এখন এমন এক নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে যেখানে প্রতিবারের মতো রাজনৈতিক দল নয়, বরং কয়েকটি বড় শক্তি মেরুকরণের দিক নির্দেশ করছে। মাঠ-ঘাটে, প্রশাসনে, ব্যবসায়িক কার্টেলে, এমনকি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চ্যানেলেও তিনটি অদৃশ্য অ্যাক্টর-লাইন সক্রিয় হয়ে উঠেছে যা আসন্ন নির্বাচনের ফল ও পরবর্তী ক্ষমতার বিন্যাসকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে-এই মেরুকরণ প্রকৃতপক্ষে একটি বহুস্তরীয় ক্ষমতা-সংগ্রাম, যার অনেক অংশ প্রকাশ্যে দেখা যায় না।
প্রশাসনের ভেতরে ‘হাইব্রিড রিমোট-ইনফ্লুয়েন্স নেটওয়ার্ক’ : তফসিল ঘোষণার পর সবচেয়ে অস্বস্তিকর তথ্য এসেছে মাঠ প্রশাসনের ভেতর থেকে। অনেক জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এখনও আগের সরকারের কিছু প্রভাবশালী প্রশাসনিক কর্মকর্তা অঘোষিত সমন্বয় করার চেষ্টা করছেন।
তথ্য-১ : কিছু জেলায় মনোনয়ন জমার আগেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ইন্টারফেয়ারেন্স’-এর হুমকি, পুরনো ফাইল খুলে হয়রানির সতর্কতা, নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে মাঠ ছেড়ে দিতে অনুরোধ। এগুলোর পেছনে রয়েছেন পুরনো সরকারঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাবেক এমপি ও স্থানীয় ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী, যারা নির্বাচনে ‘নিজেদের মানুষ’ বসানোর টার্গেটে আছেন।
তথ্য-২ : কয়েকটি জেলায় ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্যাগিং’-প্রশাসনের অভ্যন্তরে ছোট নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, যারা নির্বাচন ঘিরে প্রযুক্তিগত সুবিধাগুলো (ডিজিটাল মনিটরিং, মাঠ রিপোর্টিং) নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এই নেটওয়ার্কগুলো তফসিলকে ‘খেলাঘর’ করে তোলার পরিকল্পনা করছে, যদিও এখনো তা পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত হয়নি।
ব্যবসায়ী কার্টেলের গোপন লবি : বাংলাদেশের বড় বড় বাণিজ্যিক গ্রুপগুলোর একটি অংশ এখনো নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক শক্তির কাছে তারা বিনিয়োগনির্ভর নিরাপত্তা পাবে- সেই নিশ্চয়তায় পৌঁছাতে পারেনি।
তথ্য-৩ : দু’টি প্রধান কার্টেল দুই দিক টানছে। কার্টেল-এ : আগের সরকারের সাথে যুক্ত ছিল। তাদের লক্ষ্য নিজস্ব আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত এমপি-মন্ত্রীদের পুনঃস্থাপন। এ কারণে তারা লোকাল লেভেল লবি চালাচ্ছে- নির্দিষ্ট প্রার্থীদের প্রচারে পূর্ব-নির্ধারিত ফান্ড। মাঠ পর্যায়ের দলীয় ডিলার ও ঠিকাদারদের সক্রিয়করণ। আর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘ব্যবসায়িক প্রেসার’ দিয়ে দুর্বল করা।
কার্টেল-বি : তারা জুলাই-পরবর্তী পরিবর্তনের পর নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলেছে। এখন তারা ‘নতুন প্রজন্মের রাজনীতি’ ও ‘রিফর্মিস্ট গ্রুপ’-এর দিকে ঝুঁকছে। উদ্দেশ্য, নতুন সরকারের অধীনে দীর্ঘমেয়াদি বাজার নিয়ন্ত্রণ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক বিনিয়োগের ভাগাভাগি এখনো অস্থির-এটিই নির্বাচনী মেরুকরণের একটি বড় কারিগর।
কূটনীতির তিনটি আলাদা চ্যানেল
তফসিল ঘোষণার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অল্প আলোচিত অংশ হলো কূটনৈতিক ব্যাকচ্যানেল যোগাযোগ।
তিন দিক থেকে চাপ : ১) ভারতীয় অক্ষ: ভারতে থাকা কিছু কৌশলবিদ স্পষ্টভাবে জানতে চাইছেন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকবে কত দিন? নতুন সরকারের ম্যাপ কেমন হবে? কারা ‘এই অঞ্চলে বেইজ-মেইনটেইন’ করতে পারবে? তারা চায় প্রেডিক্টেবল পার্টনারশিপ এবং এই কারণে কিছু নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় ‘লবিং সিগন্যাল’ পাঠানো হয়েছে।
২) পশ্চিমা অক্ষ : তাদের অগ্রাধিকার একটাই-ব্যালটের অখণ্ডতা। কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক ‘রিস্ক অ্যানালাইসিস রিপোর্ট’ তৈরি করছে-যা সাধারণত তারা কেবল সঙ্কটাপন্ন দেশের নির্বাচন ঘিরে করে।
৩) চীনা অক্ষ : চীনের যোগাযোগ সবচেয়ে ‘কম শব্দে বেশি প্রভাব’ ধাঁচের। তারা ব্যবসা ও পরিকাঠামো-নির্ভর স্টেবিলিটি চায়। তাদের পর্যবেক্ষণ- যে রাজনৈতিক শক্তি দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখবে, বিনিয়োগের প্রবাহ তার দিকেই যাবে।
ডিজিটাল ম্যানিপুলেশন চেষ্টা-প্রমাণ মিলছে ধীরে ধীরে
একটি বিশেষ অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, আগের সরকারের সাথে যুক্ত কিছু প্রযুক্তি-পেশাজীবী ও প্রাইভেট আইটি গ্রুপ সোশ্যাল মিডিয়া অপারেশন চালু করেছে।
তাদের উদ্দেশ্য : কিছু নতুন প্রজন্মের প্রার্থীকে লক্ষ্য করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো; বিদ্রোহী রাজনৈতিক ধারাকে বিভাজন করা; নির্বাচনী সংবাদকে ‘ভুয়া ডাটা’ দিয়ে নষ্ট করা; মাঠে থাকা পর্যবেক্ষক বা সাংবাদিককে বিভ্রান্ত করা। এ ধরনের অপারেশনে একটি বিদেশী ‘ডিজিটাল কনসালট্যান্সি’ জড়িত থাকার ইঙ্গিত মিলেছে-যদিও প্রমাণ এখনো প্রকাশ করা যায়নি।
বিএনপি-ওল্ড ব্লকের ‘নীরব কৌশল’ পরিস্থিতিকে জটিল করছে
সবার চোখ বিএনপির দিকে। কিন্তু দলটি প্রকাশ্যে কম, ব্যাকচ্যানেলে বেশি সক্রিয়। তাদের লক্ষ্য মনোনয়ন বাছাইয়ের পর কোন দিকে ‘ন্যারেটিভ উইন্ডো’ খুলবে তা দেখা; কোন ব্লক তাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য জায়গা করে দেবে তা নিশ্চিত হওয়া এবং তরুণ ভোটারদের সেন্টিমেন্ট বুঝে কৌশল ঠিক করা। এ কারণে তারা সরাসরি মাঠে না নেমে মেরুকরণের জোনটি পর্যবেক্ষণ করছে। এক সূত্র জানায়, বিএনপির এই নীরব কৌশল মাঠের উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনী প্রযুক্তি : স্বচ্ছতার সুযোগ বনাম সিস্টেম ক্যাপচারের ভয়
অন্তর্বর্তী সরকার ইভিএম নয়, কাগজের ব্যালটে ফিরে গেছে-এটি মেরুকরণ টোন কিছুটা কমাতে পারে। তবে সত্য হলো বুথ-লেভেল ডাটা মনিটরিং এখন অত্যন্ত উন্নত মানের। এ কারণে পুরনো নেটওয়ার্কের ভয়-এবার হয়তো তাদের কোনো ধরনের ‘স্কোর অ্যাডজাস্টমেন্ট’ বা ‘রেজাল্ট ম্যানেজমেন্ট’ সম্ভব হবে না। এই ভয় থেকেই তারা লুকোচুরি করে মাঠে চাপ তৈরির চেষ্টা করছে।
তিনটি মূল ইনভেস্টিগেটিভ ফাইন্ডিং
ফাইন্ডিং-১: মাঠ প্রশাসনে আগের সরকারের প্রভাবশালী অংশ গোপন সমন্বয় নেটওয়ার্ক চালু করার চেষ্টা করছে কিন্তু কঠোর নজরদারিতে পুরোপুরি সফল হতে পারছে না।
ফাইন্ডিং-২: ব্যবসায়ী কার্টেল এখনো নিশ্চিত নয়-কাকে সমর্থন দিলে পরবর্তী সরকারে তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ থাকবে। এই অনিশ্চয়তা নির্বাচনী মেরুকরণকে আরো অস্থির করেছে।
ফাইন্ডিং-৩: আন্তর্জাতিক অক্ষের ব্যাকচ্যানেল যোগাযোগ নির্বাচনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে যা মেরুকরণকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।
আগামী ৪ সপ্তাহ নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণকারী সময়
২৯ ডিসেম্বর-৪ জানুয়ারি : মনোনয়ন বাছাই: এই ৭ দিনেই প্রকৃত মেরুকরণ প্রকাশ পাবে।
১০ জানুয়ারি-৩০ জানুয়ারি : ভোটের আগে মাঠ দখল, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ, বরিশাল, কুমিল্লা, সিলেট-উত্তেজনা বাড়তে পারে।
নির্বাচনের আগের ৪৮ ঘণ্টা : ডিজিটাল ম্যানিপুলেশন, গুজব, টার্গেটেড অপারেশন-সবচেয়ে বেশি হবে।
তবে নির্বাচন শুধু একটি ভোট নয়, এটি হবে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের যুদ্ধে প্রবেশ।
নির্বাচন ঘিরে মেরুকরণ দৃশ্যমান নয় তবে গভীর
বাংলাদেশের নির্বাচনী মেরুকরণ এবার আর প্রচলিত ‘দল বনাম দল’ নয়। এটি হয়ে গেছে- প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ লাইন বনাম সংস্কার লাইন, ব্যবসায়ী কার্টেল বনাম জনমুখী অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক অক্ষের কূটনৈতিক চাপ, পুরনো রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক বনাম নতুন প্রজন্ম।
তফসিল ঘোষণার পর এখন চূড়ান্ত প্রশ্নটি হলো-অন্তর্বর্তী সরকার কি এই বহুমাত্রিক চাপ সামলে একটি ইনটিগ্রিটি-ভিত্তিক নির্বাচন বাস্তবায়ন করতে পারবে?
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ জুলাই পরিবর্তনের রাজনীতি ধরে রাখতে পারবে, নাকি পুরনো নেটওয়ার্কের আড়াল থেকে পরিচালিত শক্তিগুলো আবার নিজেদের জায়গা বানিয়ে নেবে।



