রফতানি বৈচিত্র্যে সরকারের নতুন উদ্যোগ

৪৬টি আন্তর্জাতিক মেলায় অংশ নেয়ার পরিকল্পনা

শাহ আলম নূর
Printed Edition

বাংলাদেশের রফতানি ঝুঁড়িকে বৈচিত্র্যময় করার লক্ষ্যে সরকার আগামী অর্থবছরে বড় ধরনের কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তৈরী পোশাক নির্ভর রফতানি খাতকে নতুন বাজার ও নতুন খাতে প্রসারিত করতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আটটি সম্ভাবনাময় খাতের রফতানিকারকদের ৪৬টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়া হবে। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আয়োজন করা হবে আন্তর্জাতিক মানের ‘গ্লোবাল সোর্সিং এক্সপো’, যা বাংলাদেশে বৈশ্বিক ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রফতানি আয় নির্ভর করছে দুটি প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর। বিশেষ করে তৈরী পোশাক (আরএমজি) খাত মোট রফতানির প্রায় ৮৩ শতাংশ দখল করে আছে। যদিও পোশাক খাত বাংলাদেশের সাফল্যের মূল চালক, তবে একই সাথে এটি দেশের জন্য একটি ঝুঁকিও বয়ে আনছে। বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমে গেলে বা বাণিজ্যনীতিতে পরিবর্তন এলে দেশের সামগ্রিক রফতানি আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।

এমন প্রেক্ষাপটে সরকার নতুন বাজার যেমন পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে লক্ষ্য করে রফতানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে। একই সাথে অপ্রচলিত খাত যেমন কৃষি-প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চামড়া, ওষুধ, আসবাবপত্র, হস্তশিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এ পুরো উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করছে। ইপিবি জানিয়েছে, এবার ৪৬টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, যা গত বছরের ৩৬টির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

ইপিবির ফেয়ার পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, দেশের প্রধান ও সম্ভাবনাময় রফতানি পণ্যকে কেন্দ্র করে আমরা ৪৬টি মেলায় অংশগ্রহণ করব। শুরুর দিকে বুকিং দিলে খরচ কমে আসে এবং ভালো অবস্থান পাওয়া যায়। ইতোমধ্যেই কয়েকটি মেলার জন্য রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে বলে তিনি জানান।

সরকার রফতানিকারকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ ফি ভর্তুকি দেবে। বড় রফতানিকারকরা পাবেন ৩০ শতাংশ, মাঝারি প্রতিষ্ঠান ৪০ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) ৫০ শতাংশ এবং নারী উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ সহায়তা পাবেন। এতে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এ দিকে আগামী ১-৩ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে গ্লোবাল সোর্সিং এক্সপো ‘সোর্সিং বাংলাদেশ’। এটি হবে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের সোর্সিং মেলা, যেখানে অগ্রাধিকার খাতের প্রায় ২০০ রফতানিকারক অংশ নেবেন। মেলায় অন্তত ৫০ জন শীর্ষ আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ড প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের জন্য সরকার আবাসন ও যাতায়াতসহ বিশেষ আতিথেয়তা প্যাকেজ দেবে। মেলায় থাকবে বি-টু-বি ম্যাচমেকিং সেশন, সেমিনার, নেটওয়ার্কিং প্রোগ্রাম ও পণ্যের প্রদর্শনী।

ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, সোর্সিং বাংলাদেশ এক্সপো হবে একটি ঐতিহাসিক আয়োজন। এটি শুধু রফতানিকারকদের জন্য নতুন দরজা খুলবে না, বরং বিদেশী ক্রেতাদেরও বাংলাদেশে আসতে উৎসাহিত করবে। আন্তর্জাতিক মেলার তুলনায় অনেক কম মূল্যে বুথ বরাদ্দ দেয়া হবে, যেখানে বিদেশে একটি বুথের জন্য ৪-৫ হাজার ডলার গুনতে হয়, সেখানে ঢাকায় এই খরচ মাত্র এক হাজার ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ বছর পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের জন্য ১৭টি মেলা আয়োজন করা হবে, যার মধ্যে রয়েছে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি।

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মোহিউদ্দিন রুবেল বলেন, জাপান, দক্ষিণ আমেরিকা, কোরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও নতুন বাজার তৈরি হলে বাংলাদেশের রফতানি খাত আরো সহনশীল হবে।’

এ দিকে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, অপ্রচলিত বাজারে অংশীদারিত্ব বাড়ছে। এ কর্মসূচি আরো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর শুল্ক সুবিধা হারানোর বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ জন্য প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সাথে দ্রুত বাণিজ্য চুক্তি করা জরুরি। তিনি বলেন, জাপান একটি সম্ভাবনাময় বাজার। বর্তমানে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) নিয়ে আলোচনা চলছে। এ চুক্তি হলে রফতানি আরো বৃদ্ধি পাবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন রফতানি বৈচিত্র্যে সরকারি উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ কারণে তারা পরামর্শ দিচ্ছেন একটি গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) সেল গঠনের। এটি ক্রেতা দেশের চাহিদা, প্রবণতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে রফতানিকারকদের সহায়তা করতে পারবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম রফতানি নির্ভর অর্থনীতি। তৈরী পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য খাতকে বৈচিত্র্যময় করা হলে অর্থনীতি আরো স্থিতিশীল হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মেলা ও গ্লোবাল সোর্সিং এক্সপোর মতো আয়োজন দেশীয় শিল্পকে নতুন মাত্রা দেবে। ‘সোর্সিং বাংলাদেশ’ এক্সপোকে কেন্দ্র করে দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে যে সেতুবন্ধন তৈরি হবে, তা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।