ইইউর বাজার ধরে রাখতে নতুন পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশ

শাহ আলম নূর
Printed Edition
  • নভেম্বরে আসছে ইইউ ট্যাক্সেশন টিম
  • বাড়ছে রফতানিকারকদের ওপর চাপ

বাংলাদেশের রফতানিনির্ভর অর্থনীতির সবচেয়ে বড় গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। পোশাক, চামড়াজাত দ্রব্য, জুতা, কৃষিপণ্য ও হিমায়িত খাবার থেকে শুরু করে অসংখ্য পণ্য ইউরোপের বাজারে পৌঁছে দেয় বাংলাদেশের

রফতানিকারকরা। দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই মহাদেশ থেকে। এমন পরিস্থিতিতে এ বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা বজায় রাখা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, এখন সেই বাজার প্রবেশাধিকার টিকিয়ে রাখতে যাচাই প্রক্রিয়ার মুখে পড়ছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নভেম্বরে ইউরোপীয় কমিশনের ডিরেক্টরেট-জেনারেল ফর ট্যাক্সেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইউনিয়নের (ডিজি ট্যাক্সইউডি) একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসছে। তাদের সফরের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশী রফতানিকারকরা জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সের (জিএসপি) আওতাভুক্ত নিয়মগুলো মেনে চলছে কি না তা সরেজমিন যাচাই করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ অস্ত্র ছাড়া সবকিছু (ইবিএ) স্কিমের আওতায় ইইউতে প্রায় সব ধরনের পণ্য শুল্কমুক্ত রফতানি করছে। তবে এ সুবিধা পেতে হলে রফতানিকারকদের রুল অব অরজিন অর্থাৎ পণ্যের উৎস নির্ধারণের নিয়ম মেনে চলতে হয়। এ নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য সংযোজন থাকতে হবে এবং এর প্রমাণ দিতে হবে রফতানিকারকদের।

তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশকে ২০১৭ সালে ইইউ জানায় যে, ভবিষ্যতে রফতানি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য নিবন্ধিত রফতানিকারক (আরইএক্স) সিস্টেম চালু করতে হবে। ২০১৯ সাল থেকে এ সিস্টেম বাংলাদেশে কার্যকর হয়। এর আওতায় রফতানিকারকদের ইপিবির (রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো) মাধ্যমে নিবন্ধিত হতে হয় এবং নিজেরাই উৎপত্তি সংক্রান্ত বিবৃতি (এসওও) দিয়ে পণ্যের উৎস ও শুল্কমুক্ত সুবিধার যোগ্যতা ঘোষণা করে।

ইপিবি পরিচালক আবু মুখলেস আলমগীর হোসেন বলেন, ইপিবি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আরইএক্স সিস্টেম বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ৩০০ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এ সিস্টেমে নিবন্ধন নিয়েছে।

তিনি আরো জানান, ইইউ প্রতিনিধিদল মূলত আরইএক্স সিস্টেম কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, রুলস অব অরিজিন মানা হচ্ছে কি না, স্টেটমেন্ট অন অরিজিন যথাযথভাবে জমা দেয়া হচ্ছে কি না এবং স্থানীয় মূল্য সংযোজন নির্ধারিত মাত্রায় আছে কি না তা যাচাই করবে।

ইপিবি ইতোমধ্যে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিটিটিএলএমইএ, লেদারগুডস ও ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ফল-সবজি রফতানিকারক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, তাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত এসওও জমা দিতে হবে এবং ইপিবির এক্সপোর্ট ট্র্যাকার সিস্টেমে তথ্য হালনাগাদ রাখতে হবে। সেই সাথে সংগঠনগুলোকেও নিজেদের পর্যায়ে সদস্য কারখানার কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি রফতানিনির্ভর। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট রফতানি আয় হয়েছে ৪৮.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ইইউ বাজার থেকে এসেছে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। বিশেষত পোশাক খাতেই ইউরোপের ওপর নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি।

বিশ্লেষকদের মতে, ইইউ বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখা না গেলে রফতানির খরচ বেড়ে যাবে, প্রতিযোগিতা কমে যাবে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া কিংবা আফ্রিকার বাজারের দিকে ঝুঁকতে পারে। বাংলাদেশ যদি ইইউর নিয়ম মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, তাহলে শুধু পোশাক খাত নয়, কৃষি, চামড়া ও হিমায়িত খাদ্য রফতানিও সঙ্কটে পড়বে। এ জন্য সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।

রফতানিকারকদের দাবি, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরইএক্স সিস্টেম বাস্তবায়নে তেমন সমস্যা নেই। তবে মাঝারি ও ছোট কারখানাগুলোতে ডকুমেন্টেশন জটিলতা ও জনবল স্বল্পতার কারণে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। একজন মাঝারি আকারের রফতানিকারক বলেন, আমরা নিয়ম মানার চেষ্টা করি, কিন্তু অনেক সময় ডকুমেন্ট আপলোড ও যাচাইয়ের কাজ ঝামেলাপূর্ণ হয়ে পড়ে। সরকার যদি কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ বাড়ায়, তাহলে আমাদের জন্য বিষয়টা সহজ হবে।

বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হবে। এরপর বর্তমানের ইবিএ সুবিধা আর বহাল থাকবে না। তখন বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের আওতায় প্রবেশের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে শুধু বাণিজ্যিক নিয়ম নয়, সামাজিক, শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নভেম্বরে ইইউ প্রতিনিধিদলের এই সফর বাংলাদেশকে আগাম সতর্কবার্তা দেবে এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের জন্য ইইউ বাজার শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে স্থিতিশীল ক্রেতা গোষ্ঠী। ফলে ইইউর নিয়ম মেনে চলা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রফতানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে ইইউ বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখা জরুরি। অন্য দিকে ভবিষ্যতের জন্য জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হবে। নভেম্বরে ইইউ প্রতিনিধিদলের সফর বাংলাদেশী রফতানিকারকদের জন্য বড় পরীক্ষা। নিয়ম মেনে চলা, স্বচ্ছ ডকুমেন্টেশন, সঠিক তথ্য হালনাগাদ এবং স্থানীয় মূল্য সংযোজন নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ শুধু বর্তমান সুবিধা বজায় রাখবে না, বরং ভবিষ্যতের আরো বড় বাজার সুযোগও কাজে লাগাতে পারবে।