- বৈরী আবহাওয়ায় সারা দিন ঝড়ো বৃষ্টি
- সাগর উত্তাল, লঞ্চ চলাচল বন্ধ
- উপকূলে ৫০-৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়
- তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল, পানির স্রোতে ভেসে গেছে কাঁচা ঘরবাড়ি
- প্রবল বৃষ্টিতে ৬ জেলায় বন্যার পূর্বাভাস
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। গতকাল বিকেল থেকে এটি উপকূল অতিক্রম করেছে। এ সময় ৪ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এ সময় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। অমাবস্যা ও গভীর নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ২-৪ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে। ভোলার দৌলতখান, তজুমদ্দিন, মনপুরা, চরফ্যাশনের চরকুকরী-মুকরী, ঢালচর, পটুয়াখালীর চরমোন্তাজের বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব উপকূলীয় জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সম্ভাব্য ঝড় জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এ দিকে গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে অব্যাহত বৃষ্টিপাতে সারা দেশে বৈরী আবহায়ায় সাধারণ মানুষকে চরম বোগান্তিতে সারা দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে।
নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল বৃহস্পতিবার সারা দিনই ছিল সারা দেশ বর্ষণমুখর। গতকাল ভোর থেকে সুস্পষ্ট লঘুচাপ থেকে নিম্নচাপে পরিণত হয় এবং এর প্রভাবে সারা দেশেই বৃষ্টি শুরু হয়। পরে বিকাল তিনটার দিকে নিম্নচাপটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। আজ কোনো এক সময় এটি লঘুচাপে পরিণত হতে পারে। পূর্বাভাস অনুসারে আজ শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল বিকেল থেকে বাংলাদেশের পটুয়াখালীর খেপুপাড়া থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ পর্যন্ত বিশাল এলাকার উপর দিয়ে গভীর নিম্নচাপটি উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে দুই দেশেরই উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এটি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার আগেই সাতক্ষীরা ও এর সংলগ্ন এলাকায় স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে গেছে। এর পরবর্তী ধাপে স্থল গভীর নিম্নচাপটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় (দুই দিনে) ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগ এবং এর পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের অনেক জায়গায় ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (৮৮ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে। অর্থাৎ স্থল গভীর নিম্নচাপ থেকে স্থল নিম্নচাপ এবং স্থল লঘুচাপ হয়ে বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে এক সময় গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। এর প্রভাবে উপকূল এলাকার স্থলভাগে ছিল ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঝড়ো হাওয়ার সাথে ভারী বৃষ্টি।
অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমি ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। একই কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে অস্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতাও সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস সতর্ক করেছে। এ দিকে বৃষ্টির কারণে গতকাল সারা দেশেই চলমান তাপমাত্রা কমে গেছে ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ও অবসান হয়েছে ভ্যাপসা গরমের। তবে আজ শুক্রবার বৃষ্টি থাকলেও তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর।
ঢাকা শহরে সকাল থেকে বৃষ্টির শুরু। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আবহাওয়া বিভাগ বলেছে ঢাকা শহরে ৮৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি, আজ শুক্রবার পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টির কারণে রাজধানীর অনেক রাস্তায় পানি উঠেছে। ভারী বৃষ্টির কারণে চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে কিছু রাস্তা। ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন অনেক এলাকার মানুষ। পলিথিন ও অন্যান্য কিছু দিয়ে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে থাকায় পানি উপচে রাস্তা তলিয়ে গেছে অনেক এলাকায়। অফিস ফেরত মানুষের বাসায় ফেরায় কষ্টের শেষ ছিল না। ভারী বৃষ্টির সাথে ছিল ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বাতাসের ঝাপটা। রিকশা, ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা, ছাতা মাথায় দিয়ে চলাচল মানুষের ছাতা বাতাসের ঝাপটায় উড়িয়ে নেয়ার অনেক ঘটনা দেখা গেছে। তদুপরি গতকাল বিকেলে ছিল প্রচণ্ড যানজট। এত যানজটের মধ্যে নারীদের কষ্টের সীমা ছিল না। তারা না পাচ্ছিলেন বাসে উঠতে আবার চড়া ভাড়াও রিকশাও পাননি।
ভারী বৃষ্টিতে নিচু এলাকার মানুষ এবং বস্তিতে বাস করা মানুষের দুঃখের সীমা ছিল না। বাঁশের মাচা দিয়ে তৈরি করা ঘরের নিচ দিয়ে সব সময় নোংরা পানি বয়ে চলে, গতকাল পানি বেড়ে মাচায় তৈরি মেঝেটাও ডুবিয়ে দিয়েছে। ফলে বৃষ্টির মধ্যেই অনেকেই ঘর থেকে বের হয়ে কাছাকাছি রাস্তায় গিয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য কাছাকাছি ভবনের নিচে শুয়ে-বসে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছেন।
অভ্যন্তরীণ রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা : বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে নদীতে বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। ওই নিম্নচাপের প্রভাবে সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত এবং অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোতে ২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সঙ্কেত জারি হওয়ায় উপকূলীয় নৌ পথসহ অভ্যন্তরীণ নৌ পথগুলো উত্তাল রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যাত্রী সাধারণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী সব ধরনের নৌযানের চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করা হলো।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে বরিশালে টানা বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে বরিশাল নদীবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে সব ধরনের ছোট লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে করে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের উপপরিচালক সেলিম রেজা জানিয়েছেন, আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী বরিশাল নদীবন্দরকে ২ নম্বর এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্কসঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ছোট আকারের যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সৃষ্ট লঘুচাপটি এখন সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে গত বুধবার রাত থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কখনো মুষলধারে, কখনো হালকা বৃষ্টি হচ্ছে বরিশালে। সাথে রয়েছে ঝড়োহাওয়া, যার গতি সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার এবং সর্বনি¤œ ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে এবং এই বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে স্কুল ও অফিসগামী মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় ভোলা, মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলার যাত্রীরা পড়েছেন দুর্ভোগে। বরিশালের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে, তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাহাদাত শাহিন, ভোলা থেকে জানান, ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে গতকাল সকাল থেকে ভোলায় বৃষ্টির সাথে বইছে তীব্র বাতাস। উত্তাল মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর পানি। এমন পরিস্থিতিতে জেলার অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার পাঁচটি নৌরুটে লঞ্চ ও দু’টি রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। গতকাল সকালে বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
ভোলা নদীবন্দরের উপপরিচালক মো: রিয়াজ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ঘূর্ণিঝড় শক্তির কারণে সমুদ্রবন্দর এলাকায় ৩ নম্বর বিপদসঙ্কেত দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করায় হাতিয়া-ঢাকা, ভোলা-লক্ষ্মীপুর, ভোলা-আলেকজান্ডার, ভোলা-তজুমদ্দিন-মনপুরা ও চরফ্যাসন বেতুয়া-মনপুরা রুটের সব লঞ্চ চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
এ ছাড়াও ইলিশা ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মো: কাওসার আহমেদ খান জানিয়েছেন, গত বুধবার দিনগত রাত থেকে ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরী ঘাট ও ভোলার ভেদুরিয়া থেকে বরিশালের লাহার হাট ঘাটে কোনো ফেরি ছেড়ে যায়নি। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ দু’টি রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে।
এদিকে, পাঁচটি নৌরুটে লঞ্চ ও দু’টি রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। জরুরি কাজে কেউ কেউ ঘর থেকে বের হয়ে ঘাটে গিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। উত্তাল রয়েছে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী। মাছ ধরার সব নৌকা ও ট্রলার জেলেরা নিরাপদে নিয়ে এসেছেন। উপকূলীয় এলাকা জুড়ে মাইকিং করা হচ্ছে।
এদিকে বাসস জানায়, বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট লঘুচাপটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিচ্ছে। এর প্রভাবে বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকেই জেলায় ব্যাপক বৃষ্টি ও ঘূর্ণি বাতাস বইছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল জোয়ারের স্রোতে জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকিমউদ্দিন বাজারের বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
এ ছাড়াও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরার কলাতলীতে বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতিকর খবর মিলেছে।
স্থানীয়রা জানান, তজুমদ্দিন উপজেলা শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে বাড়িঘর ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারে জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধে মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছেন।
ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তারা জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেড়িবাঁধগুলোর সার্বিক বিষয়ে তদারকি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিআইডব্লিউটিএর ভোলার বন্দর কর্মকর্তা রিয়াদ হোসেন বলেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ইলিশা নৌবন্দরের টার্মিনালের চালা উড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পন্টুন।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো: আজাদ জাহান জানান, ঝড়ের সার্বিক দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলায় ৮৬৯টি আশ্রয়ণকেন্দ্র ও ১৪টি মাটির কেল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও সিপিপি ও রেড ক্রিসেন্টসহ ১৩ হাজার আট শ’ স্বেচ্ছাসেবী ও ৯৭টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যেকোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী মোট তিন ধাপের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। মেডিক্যাল টিম, শুকনো খাবার ও চাল মজুদ রাখার পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।
এ ছাড়াও বিচ্ছিন্ন উপকূলীয় দ্বীপে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে আনতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মজুদ রাখা হয়েছে দুই শ’ ৯১ মেট্রিন টন চাল, দেড় হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও পাঁচ লাখ টাকার শিশুখাদ্য।
পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি দফতরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক রাখা হয়েছে।
ভোলা জেলা আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো: মনিরুজ্জামান জানান, ভোলা উপকূল এলাকার সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর সতর্কসঙ্কেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদফতর। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
গোলাম কিবরিয়া ও মাহমুদ হাসান, পটুয়াখালী থেকে জানান, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে সাগরদ্বীপ ও পটুয়াখালীর খেপুপাড়া কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। এটি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে গতকাল সন্ধ্যায় উপকূল অতিক্রম করছে এবং ক্রমেই দুর্বল হতে পারে।
এর প্রভাবে ভোররাত থেকেই পটুয়াখালীর উপকূলে দমকা বাতাসসহ মুষলধারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪২.৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে। জেলাশহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে নৌপথ নির্ভর রাঙ্গাবালী উপজেলা। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৪ ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে পুরো চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন এবং চরমোন্তাজের মিটার বাজার, চর আন্ডা, হিন্দু গ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষ। এ দিকে সকাল থেকেই জেলার নৌপথে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অমাবস্যা ও গভীর নিম্নচাপের কারণে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ২-৪ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলা হয়।
নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বৈরী আবহাওয়ার কারণে সব ধরনের ছোট নৌযান, ট্রলার, স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পটুয়াখালী-ঢাকা রুটের যাত্রীবাহী লঞ্চ আপাতত চালু থাকলেও পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনা বহাল থাকবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মাছ ধরার উপরে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলায় গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলার তীরে নিরাপদে আছে। তবে সমুদ্র এখন প্রচণ্ড উত্তাল।’
বাসস জানায়, সমুদ্রে লঘুচাপে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করায় পটুয়াখালীর অভ্যন্তরীণ ১৭টি রুটে ছোট-বড় সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ। এ দিকে ঢাকা-পটুয়াখালীগামী দোতলা বড় বড় যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো নিয়মিতভাবে চলাচল করবে।
জেলা নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক মো: জাকী শাহরিয়া জানান, সমুদ্রে লঘুচাপের কারণে পায়রা বন্দরকে ৩ নম্বর সঙ্কেত বিরাজ করায় এবং জেলা নদীবন্দরগুলো ২ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত থাকায় জেলায় অভ্যন্তরীণ ১৭টি রুটের নিচে সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার সব স্পিডবোর্ড যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এ দিকে বাসস আরো জানায়, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হওয়ায় চাঁদপুর জেলায় মুষলধারে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বইছে; যে কারণে ছোট নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এ দিকে লঘুচাপের কারণে জেলার নদ-নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি এবং নদীতে স্রোত ও ঢেউ বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলীয় জেলা চাঁদপুরের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোকে ২ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেতের আওতায় আনা হয়েছে।
অন্য দিকে চলমান ঝড়বৃষ্টি থাকায় বিপাকে পড়েছেন খেটেখাওয়া মানুষ। এতে সড়কে যানবাহন ও মানুষের চলাচল কমে গেছে। শহরের বিভিন্ন মোড়ে ও বাজার এলাকায় দেখা গেছে মানুষের তুলনামূলক উপস্থিতি কম।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) সংবাদদাতা জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বৈরী আবহাওয়ায় নদী উত্তাল থাকায় সকাল ৯টা থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে লঞ্চ চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গোপাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে পদ্মা নদীতে প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলা বাতাসে প্রচণ্ড ঢেউয়ে উত্তাল পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এ রুটে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়ে।
এ রুটে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে যাত্রী ও যানবাহন খুবই কম। বৈরী আবহাওয়ায় নদী উত্তাল থাকায় যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে লঞ্চ চলাচল বন্ধ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে এলে আবার লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক করা হবে।
দেশের ৬ জেলায় বন্যার আভাস
এ দিকে দেশের ছয় জেলায় বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সংস্থাটি জানিয়েছে, এসব ফেনী, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা এলাকার নদ-নদীগুলো বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। একই সাথে নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী দুই দিন চট্টগ্রাম বিভাগের গোমতী, মুহুরী ও ফেনী ইত্যাদি নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে; এবং এই সময় মুহুরী নদীর পানি সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এই সময়ে ফেনী জেলার মুহুরী নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। পরবর্তী একদিন নদীগুলোর পানি সমতলে হ্রাস পেতে পারে।
এ ছাড়া সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, জাদুকাটা, মনু, ধলাই, খোয়াই ও সোমেশ্বরী নদীগুলোর পানি সমতলে আগামী তিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এই সময়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় ওই নদীগুলো সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীগুলোর পানি সমতলে আগামী তিন দিন বৃদ্ধি পেতে পারে; এবং তিস্তা নদী সতর্কসীমায় প্রবাহিত হতে পারে। আগামী দু’দিন পর্যন্ত বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় নদীগুলোতে স্বাভাবিক অপেক্ষা অধিক উচ্চতায় জোয়ার পরিলক্ষিত হতে পারে।
এ দিকে সুরমা, কুশিয়ারা নদীর পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী তিন দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, ছয় জেলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তবে বৃষ্টিপাত কমে গেলে পানি নেমে যাবে।