পুঁজিবাজারে দীর্ঘ দিন ধরেই নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে চলছে স্থবিরতা। সর্বশেষ সংশোধিত আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) বিধিমালা কার্যকরে বিলম্ব ও বিদ্যমান বিধিমালায় নানা জটিলতায় নতুন করে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহ হারাচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। এতে এক দিকে যেমন পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সঙ্কুচিত হচ্ছে, অন্য দিকে বাজারের গভীরতা ও বৈচিত্র্য কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আইপিওকে দীর্ঘ দিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নতুন ও ভালো মানের কোম্পানি বাজারে এলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে, লেনদেনের পরিধি বিস্তৃত হয় এবং বাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছরে আইপিওর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিশেষ করে সংশোধিত আইপিও বিধিমালা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় অনেক কোম্পানি তাদের তালিকাভুক্তির পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে কার্যকর আইপিও বিধিমালায় একাধিক ধারা ও শর্ত রয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের কাছে জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে বিবেচিত হচ্ছে। ন্যূনতম মুনাফা, অডিট-সংক্রান্ত শর্ত, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, বুক বিল্ডিং পদ্ধতির প্রয়োগ এবং মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া সব মিলিয়ে আইপিওতে যেতে একটি কোম্পানিকে দীর্ঘ প্রশাসনিক ও নীতিগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এতে সময় যেমন বাড়ে, তেমনি ব্যয়ও বেড়ে যায়।
বিশেষ করে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। এক সময় এই পদ্ধতির মাধ্যমে অতিমূল্যায়িত শেয়ারের আইপিও আসায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা শর্ত কঠোর করলেও উদ্যোক্তাদের একটি অংশ মনে করছেন, বর্তমানে এই পদ্ধতির কাঠামো খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে অনেক ভালো কোম্পানি সরাসরি ব্যাংক ঋণ বা প্রাইভেট ইকুইটির দিকে ঝুঁকছে এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দীর্ঘ দিন ধরেই আইপিও বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগের কথা বলে আসছে। বাজারের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, বিনিয়োগকারী, ইস্যু ম্যানেজার, উদ্যোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের সাথে আলোচনা করে একটি আধুনিক ও বিনিয়োগবান্ধব বিধিমালা তৈরির প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে সেই সংশোধিত বিধিমালা কার্যকরে বিলম্ব হওয়ায় অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে।
তারা বলছেন, ২০২৫ সাল শেষের পথে, অথচ দেশের পুঁজিবাজারে একটি কোম্পানিও নতুন করে তালিকাভুক্ত হয়নি যা বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এক বিরল ও উদ্বেগজনক ঘটনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান কমিশন এখনো সংশোধিত আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) বিধিমালা চূড়ান্ত করতে না পারায় নতুন তালিকাভুক্তি কার্যত থমকে আছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে থাকা পাবলিক ইস্যু রুলসের সংশোধন না হওয়াতেই মূলত কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ব্র্যাক ইপিএল স্টকব্রোকারেজের গবেষণা বিভাগের প্রধান সালিম আফজাল শাওন বলেন, ইস্যুয়ার কোম্পানি ও ইস্যু ম্যানেজাররা চূড়ান্ত তালিকাভুক্তি বিধিমালার অপেক্ষায় ছিলেন। নিয়মের অনিশ্চয়তায় কেউই ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তিনি বলেন, বর্তমান কমিশন বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে, যা প্রয়োজনীয় হলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে নতুন তালিকাভুক্তি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গঠিত নতুন কমিশন বাজার সংস্কারের অংশ হিসেবে পাবলিক ইস্যু রুলসে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়। কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব পরিবর্তনের লক্ষ্য হচ্ছে যোগ্যতার মানদণ্ড আরো স্পষ্ট করা, ইস্যু ম্যানেজারদের জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং স্টক এক্সচেঞ্জ পর্যায়ে শক্তিশালী যাচাই-বাছাই নিশ্চিত করা, যাতে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী ও মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলো ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে বাজারে আসে।
তবে সংস্কারের এই প্রক্রিয়ায় কমিশন গত ১৭ মাসে প্রায় এক ডজন ঝুলে থাকা আইপিও আবেদন বাতিল করেছে। বিএসইসি বলছে, এটি ছিল বাজার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অংশ। কিন্তু বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এর ফলে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি কমিশনের অগ্রাধিকার তালিকায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে।
দেশের পুঁজিবাজারে সর্বশেষ আইপিও আসে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেকনো ড্রাগসের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির সাবস্ক্রিপশন শেষ হয় গত বছরের জুনে। সাবেক কমিশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন এই আইপিও অনুমোদন দিয়েছিল। টেকনো ড্রাগস প্রাথমিক শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৬ বছরে গড়ে প্রতিবছর ১০টি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এমনকি ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ২৬টি প্রতিষ্ঠান বাজারে আসে। সর্বশেষ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে নতুন কোম্পানি না আসার পেছনে আরো কিছু কাঠামোগত কারণও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তালিকাভুক্তির জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনার অভাব, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে অপ্রত্যাশিত বা কম আকর্ষণীয় মূল্যায়ন, ব্যাংকঋণ সহজলভ্য হওয়া এবং দীর্ঘ ও জটিল আইপিও অনুমোদন প্রক্রিয়া। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রায় সব খাতেই, এমনকি ব্লু-চিপ শেয়ারেও দরপতন অব্যাহত থাকায় বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের সরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। নতুন আইপিও না থাকায় বাজারে বিনিয়োগের বিকল্প সঙ্কুচিত হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ হয়েছে। চলতি বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ পারফরমার হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারের প্রধান সমস্যা হলো এখানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগযোগ্য ইক্যুইটি নেই। তার মতে, শুধু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলেই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে মৌলভিত্তিসম্পন্ন নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি অত্যন্ত জরুরি। চলতি বছরের মে মাসে প্রধান উপদেষ্টা এক বৈঠকে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দেন। তবে সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
নতুন আইপিও উৎসাহিত করতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ, ওষুধ শিল্পের সংগঠন বাপিসহ (বিএপিআই) বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের সাথে একাধিক বৈঠক করেছে। যদিও এসব আলোচনা এখনো বাস্তব ফলাফলে রূপ নেয়নি।
এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র মো: আবুল কালাম বলেন, সংশোধিত পাবলিক ইস্যু রুলস শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে। আমরা আশা করছি, চলতি মাসের শেষ নাগাদ ২০২৫ সালের পাবলিক ইস্যু রুলসের গেজেট প্রকাশ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, নতুন বিধিমালার মাধ্যমে ভালো পারফরম্যান্স করা কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহ দেয়া হবে এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় স্বচ্ছ মূল্যায়নের ওপর জোর দেয়া হবে। একই সাথে ইস্যুয়ারদের জন্য প্রক্রিয়া আরো সহজ করা হবে।
এ দিকে বর্তমানে কোনো আইপিও আবেদন প্রক্রিয়াধীন নেই বলে স্বীকার করেন বিএসইসির এই মুখপাত্র। তিনি জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাংলাদেশে কার্যরত বহুজাতিক কোম্পানির সরকারি শেয়ার অফলোডিং নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চলছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে কিছু স্বনামধন্য কোম্পানি, এমনকি কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানও শেয়ারবাজারে আসতে পারে।
সাম্প্রতিক খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে এক বৈঠকে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ আশ্বাস দেন, সংশোধিত আইপিও বিধিমালার আওতায় বাজারে আসতে আগ্রহী কোম্পানিগুলো ন্যায্য মূল্য পাবে। তার মতে নতুন সংশোধনীগুলো তালিকাভুক্তি কাঠামো আধুনিকীকরণ এবং নিয়ন্ত্রক তদারকি জোরদারের বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ। ওই বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং সরাসরি তালিকাভুক্তিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, এখন কোম্পানিগুলোর প্রস্তুতি নেয়ার সময়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং শিগগিরই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে।



