- হাতেনাতে ধরা না পড়লে মাদকের মামলা হয় না
- অভিযান বন্ধ করতে উল্টো মামলা করে কারবারিরা
- অবৈধ সিসাবারে সয়লাব
একদিকে চলছে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান, মাদককে না বলার বিভিন্ন স্লোগান। মাদককারবারিদের মূল উৎপাটন করতে গঠন করা হচ্ছে বিভিন্ন কমিটি। অন্য দিকে আইনের মারপ্যাঁচে সহজেই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মাদকের গডফাদাররা। শুধু তাই নয়, অপরাধী হয়েও মাদকবিরোধী অভিযানগুলোর বিরুদ্ধে আদালতে করছেন মামলা ও রীট। নানা বাধা উপেক্ষা করেও যেসব কর্মকর্তা মাদকের গডফাদারদের টুটি চেপে ধরার চেষ্টা করছেন তাদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে নানা কুৎসা। বদলি করার জন্য মাদককারবারীদের পক্ষ থেকে ঢালা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বিশেষ করে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের তৈরি করা সিন্ডিকেটের সদস্যরাই এমন তৎপরতা দেখাচ্ছেন। এতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নতুন দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা কিছুটা বিচলিত হলেও থেমে থাকছেন না। গত কয়েক দিন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ ও বিভিন্ন বার সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আইনের মারপ্যাঁচ : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে রয়েছে ‘হাতেনাতে মাদকসহ ধরা না পড়লে কারো নামে মামলা করা যাবে না’। বিশাল প্রস্তুতি নিয়ে অভিযানে গেলেও এই জায়গায় দুর্বল হয়ে পড়ে অধিদফতর বা পুলিশের কর্মকর্তারা। কারণ গডফাদাররা কখনো মাদক বহন করেন না। এমনকি বাহকের টাচেও থাকতে চান না। বাইরে থেকে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে হলে তার কানেক্টিভিটির সন্ধান করা হয়। এ ক্ষেত্রে হতে পারে অর্থ লেনদেন, মোবাইলে কথোপকথন। কোনো কিছু না পেলে অবশেষে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দিতে হয়। কারণ মাদককারবারীরা দ্রুত বিপুল অর্থের মালিক বনে যান। তিনি এই বিপুল অর্থের মালিক হলেন কিভাবে তার সন্ধান খুঁজতে গিয়ে অনেক সময় মাদকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। আর যদি সেটাও না পাওয়া যায় তাহলে তাকে ধরে রাখা সম্ভব হয় না। অন্য কোনো ধারায় মামলা দিলে সহজেই জামিনে বেরিয়ে এসে ফের মাদক কারবার শুরু করে। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ছাড়াও সরকারের আরো কিছু সংস্থা রয়েছে, যারা গডফাদারদের গ্রেফতার করতে পারে।
অধিদফতরের অভিযানের বিরুদ্ধে মামলা
অপরাধ করেও উল্টো মাদকবিরোধী অভিযানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দেয় মাদককারবারীরা। গত বছরের ৫ আগষ্টের পর এ পর্যন্ত প্রায় ১২টি মামলা ফেস করতে হয়েছে কর্মকর্তাদের। জানা গেছে, অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছেমতো মাদক আমদানিতে বাধা দেয়ায় আসাদুজ্জামান কামালের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের সদস্যরা এই মামলাগুলো দায়ের করে। সূত্র মতে, একটি বার বা ডিউটি ফ্রি শপ চালাতে হলে বারের লাইসেন্স নেয়ার পরও বিদেশ থেকে মদ আমদানির ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমোদন নিতে হয়। এ ছাড়া, ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউজগুলোর ক্ষেত্রেও একাধিক অনুমোদন নিতে হয়। যেমন তারা কোন কোন ব্র্যান্ডের মদ আমদানি করবেন, কী পরিমাণ আমদানি করবেন, আমদানি প্রাপ্যতা ও পূর্বানুমতি গ্রহণ করে সব ক্ষেত্রে অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে আমদানি করতে হবে। এমনকি মদ আমদানির সময় পোর্টে অধিদফতরের অনাপত্তিপত্র প্রাপ্তি সাপেক্ষে খালাস প্রদান এবং আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে আনার পর অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট অফিসারের সামনে কার্টুন খুলে তাকে দেখানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগের সময় গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছেমতো ব্র্যান্ডের মদ আমদানি করেন। এমনকি লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে ডিউটি ফ্রি শপ ও ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস পরিদর্শন করতে দেয়া হয় না। এতে করে একদিকে সরকারকে রাজস্ব হারাতে হয়, অন্য দিকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ মাদক নির্বিঘেœ বিক্রয় করা হয়। এ কারণে অধিদফতরের নতুন দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা অভিযান চালালেই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে যাতে এই অভিযানগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
অনুমোদন না থাকলেও শীশাবারে সয়লাব গুলশান বনানী
জ্ঞাত হিসেবে শুধু রাজধানীর বনানী এলাকায় শীশা বার রয়েছে প্রায় ২৫টি। এর বাইরে অজ্ঞাত যে আরো কতগুলো শীশাবার চালু রয়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু এর একটি শীশা বারেরও কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে আইনের মারপ্যাঁচে রেস্টুরেন্টের আড়ালে দেদারছে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব শীশাবারে হত্যাকাণ্ডসহ ঘটছে নানা অনৈতিক ঘটনা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, পয়েন্ট ২ পারসেন্টের নিচে নিকোটিন ব্যবহার হলে সেটিকে অবৈধ হিসাবে ধরা যায় না। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত শীশাবারগুলো পয়েন্ট ২ এর উপরেই নিকোটিন ব্যবহার করে বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু অভিযানে গেলে সবাই সাধু সাজে। কেউ পয়েন্ট ২ এর উপরে নিকোটিন ব্যবহার করে না জানিয়ে দেয়। তারপর আইনের অন্য ধারায় তাদের পাকড়াও করতে গেলেই আদালতে রীট করে বসে।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর (উত্তর) শামীম আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে প্রতিকুল অবস্থার মুখোমুখি হলেও থেমে নেই কোনো অভিযান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সীমিত জনবল নিয়ে এক লাখ ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের দেশে কাজ করছে। যে দেশের তিন দিক দিয়ে ঘিরে আছে প্রতিবেশী দুটি দেশ। আর দুটি দেশ থেকেই মাদক উৎপদন করে বাংলাদেশে পাচার করছে। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও বর্ডার এলাকা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাদক এ দেশে ঢুকছে। তিনি আরো বলেন, মাদক কারবারীদের রীট ও মামলা আইনিভাবে মোকাবেলা করে শীশাবারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। শুধু অধিদফতর নয় পুলিশের বিভিন্ন সংস্থাও অভিযান অব্যাহত রেখেছে। জনবল বৃদ্ধি করে আরো উন্নত টেকনোলজি পাওয়া গেলে অভিযান আরো সহজ হবে।