১০ বছরের অপেক্ষা শেষে কান উৎসবে ‘সন্স অব দ্য নিয়ন নাইট’

আলমগীর কবির
Printed Edition
১০ বছরের অপেক্ষা শেষে কান উৎসবে ‘সন্স অব দ্য নিয়ন নাইট’
১০ বছরের অপেক্ষা শেষে কান উৎসবে ‘সন্স অব দ্য নিয়ন নাইট’

বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদা পূর্ণ মঞ্চ কান চলচ্চিত্র উৎসব। আর সেই উৎসবের মধ্যরাতের বিশেষ বিভাগ ‘মিডনাইট স্ক্রিনিংস’-এ শনিবার (১৭ মে) বিশ্ব প্রিমিয়ার হলো বহুল প্রতীক্ষিত হংকং চলচ্চিত্র ‘সন্স অব দ্য নিয়ন নাইট’-এর। এটি শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং এক দশকের সাধনা, এক পরিচালকের স্বপ্ন এবং এশিয়ান সিনেমার জগতে একটি নতুন শৈল্পিক পরীক্ষার নাম।

ছবিটির কাহিনী, নির্মাণ প্রক্রিয়া ও কান-অভিষেক ঘিরে চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও সমালোচকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে জোরালো আলোচনার ঝড়। ২০১৭ সালে মূল শুটিং শেষ হলেও প্রায় ১০ বছর ধরে নির্মাণাধীন ছিল ছবিটি। অবশেষে ২০২৫ সালের মে মাসে এসে তা বড় পর্দায় বিশ্বদর্শকের সামনে হাজির হলো।

ডিস্টোপিয়ান হংকং ও অপরাধ জগতের গল্প

‘সন্স অব দ্য নিয়ন নাইট’ একটি ডিস্টোপিয়ান ক্রাইম থ্রিলার, যেখানে দেখা যায় তুষারপাতে ঢাকা এক বিকল্প হংকং শহর। প্রকৃতিতে যেখানে তুষার অস্বাভাবিক, সেই বৈপরীত্যই তুলে ধরে এক নতুন বাস্তবতার অনুভব। গল্পে দেখা যায়, একটি বিশাল ওষুধ কোম্পানির চেয়ারম্যানের মৃত্যু ঘিরে শহরের অপরাধ জগতে শুরু হয় চরম ক্ষমতার লড়াই। মৃত চেয়ারম্যানের কনিষ্ঠ পুত্র নিজেকে পরিবারের অপরাধ-ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। অথচ শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা অপরাধ ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তাকে সহজে মুক্তি দিতে চায় না।

এই মূল গল্পের মধ্যে লেখক-পরিচালক জুনো মাক ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজ, পরিবার, ক্ষমতা ও আত্মপরিচয়ের জটিল প্রশ্ন।

জুনো মাকের স্বপ্ন ও সংগ্রাম

ছবিটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় রয়েছেন হংকংয়ের উদীয়মান নির্মাতা জুনো মাক, যিনি ২০১৩ সালে তার অভিষেক চলচ্চিত্র ‘রিগর মর্টিস’ দিয়ে দর্শকদের নজরে আসেন। তবে ‘সন্স অব দ্য নিয়ন নাইট’ নির্মাণ তার জন্য সহজ ছিল না।

‘২০১৭ সালে শুটিং শেষ হলেও ছবির বিশাল সিজিআই কাজ, ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস ও পোস্ট প্রোডাকশনে সময় লেগেছে। এর মধ্যে কোভিড মহামারী আমাদের পুরো পরিকল্পনা ও সময়সূচিকে এলোমেলো করে দেয়’, বলেন মাক।

তিনি আরও জানান, নির্মাণের শুরুর দিকে অনেক প্রযোজক আমাকে ‘রিগর মর্টিস’-এর সিক্যুয়েল করতে বলছিলেন। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, শিল্পী হিসেবে নিজেকে নতুনভাবে চিনতে হবে, সে কারণেই ‘সন্স’ তৈরি করেছি।

দুর্দান্ত তারকাবহর

ছবিটিতে অভিনয় করেছেন এশিয়ান চলচ্চিত্রের একঝাঁক অভিজ্ঞ তারকা- টাকেশি কানেশিরো (‘চাংকিং এক্সপ্রেস’), সন লাউ (‘পাপা’), টোনি লিয়ং কা-ফাই (‘ডাবল ভিশন’), লুইস কু (‘ওয়াল্ড ইন’) এবং গাও ইউয়ানইউয়ান (‘ব্লাইন্ড ডিটেকটিভ’)।

বিশেষ করে টোনি লিয়ং কাণ্ডফাই ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কান উৎসবে প্রদর্শন শেষে তিনি বলেন, সাত বছর আগের সেই সময়টা আবার ফিরে এলো মনে। আমি চরিত্রটিকে নতুনভাবে উপলব্ধি করছি।

লিয়ং আরও বলেন, এই চলচ্চিত্রটি শুধু হংকং নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব শহরের একটি প্রতিচ্ছবি। বড় শহরগুলোতে সবাই ছুটছে, কিন্তু থেমে থেকে দেখছে না আশপাশের সংগ্রাম, হত্যাকাণ্ড, বেদনা।

চলচ্চিত্র ও সিনেমা হলের মাহাত্ম্য

৪০ বছরের বেশি সময় ধরে সিনেমায় কাজ করছেন টোনি লিয়ং। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, আমি ১৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেছি, এবং প্রতিটি চরিত্রই আমার জীবনে আলাদা এক জীবন দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আজকের দিনে, মানুষ সিনেমা হলে কম যাচ্ছে। মোবাইল বা ট্যাবলেটে সিনেমা দেখা অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে শত শত মানুষ এক সাথে একটি স্বপ্ন দেখে, সেই অভিজ্ঞতা অনন্য। আপনিও আসুন, সিনেমা হলে ফিরে যান।

বরফে ঢাকা কল্পনার বাস্তবতা

ছবির ব্যতিক্রমী দৃষ্টিনন্দনতা এসেছে তার পরিবেশ রচনায়। বরফে ঢাকা হংকং দেখতে অভ্যস্ত নয় দর্শকরা। অথচ সেই পরিবেশই মাক গড়ে তুলেছেন মূলত শীতপ্রবণ জায়গা ভ্রমণের অনুপ্রেরণায়। ছবির প্রায় ৮০ শতাংশ বরফ ব্যবহার করা হয়েছে বাস্তব সেটে, বাকি অংশ ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসের মাধ্যমে তৈরি। শুটিংয়ের শুরুর দিকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমে অভিনেতারা পরেছিলেন ভারী কোট, আর শেষের অংশে দক্ষিণ কোরিয়ার বরফঢাকা প্রকৃতিতে করতে হয়েছে কঠিন দৃশ্য ধারণ।

সাকামোতোর শেষ সুর

ছবিটির সঙ্গীতে যুক্ত ছিলেন সদ্যপ্রয়াত জাপানি কিংবদন্তি রিউইচি সাকামোতো। পরিচালক জানান, আমরা একসাথে টোকিওতে ছয় ঘণ্টা বসেছিলাম। তার মধ্যে ঠাণ্ডা পরিবেশ নিয়ে আগ্রহ ছিল, সে কারণেই তিনি প্রজেক্টে আগ্রহী হন। সে এক জাতুকরী সেশন ছিল। সাকামোতোর সুর ও ব্রিটিশ সঙ্গীত পরিচালক নেট কনেলির কম্পোজিশন ছবির আবহ তৈরি করে এক ভিন্ন মাত্রায়।

‘সন্স অব দ্য নিয়ন নাইট’ কেবল একটি অপরাধভিত্তিক থ্রিলার নয়। এটি শিল্পের প্রতি এক নির্মাতার নিষ্ঠা, প্রযুক্তি ও মানবিকতার মেলবন্ধন, এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রে হংকংয়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক সাহসী প্রচেষ্টা। দীর্ঘ দশক ধরে তৈরি হওয়া এই চলচ্চিত্র এখন শুধু দর্শকদের রায়ের অপেক্ষায়। এবং এই আয়োজনটি প্রমাণ করে, ভালো গল্প ও শিল্প কখনো পুরোনো হয় না, সে যত সময়ই লাগুক না কেন।