ফোনে আড়িপেতে সরকারবিরোধীদের হয়রানি, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের ওপর নজরদারি চালানোর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত। সেই প্রেক্ষাপটেই এবার বিতর্কিত এই ব্যবস্থার আইনি কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের খসড়ায় ফোনে আড়িপাতার সার্বজনিক বৈধতা বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে- শুধুমাত্র নাগরিকের জীবনরক্ষা বা তাৎক্ষণিক বিপদের মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালতের পূর্বানুমোদন নিয়ে সীমিত পরিসরে আড়িপাতা যাবে।
কিন্তু সরকারের এই উদ্যোগের বিপক্ষে মত দিয়েছে রাষ্ট্রের ১৮টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তারা পুরনো কাঠামো বজায় রেখে আড়িপাতার সুযোগ অব্যাহত রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
উচ্চপর্যায়ের বৈঠক : গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, বিটিআরসি, ডিজিএফআই, এনএসআই, র্যাব, এসবি, আনসার, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৮টি সংস্থার প্রধানরা।
সভায় ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব বলেন, ‘বিগত সময়ে আড়িপাতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা নানাবিধ অনিয়ম ও অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আইনটি সংশোধন না করলে এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে।’
সংস্থাগুলোর আপত্তি : একটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব অডিও ও ভিডিও ছড়ায়, এসব আমাদের করা নয়। অন্য একটি সংস্থার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন-ওরা এসব করে।’
আরেকটি সংস্থার প্রধান বলেন, ‘সবসময় দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। তাৎক্ষণিক মনিটরিং না করলে এসব মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আদালতের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করলে অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।’
কোস্টগার্ড প্রধান বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযানে আমরা বড় বড় চালান আটক করেছি। এই ধরনের নেটওয়ার্ক শনাক্ত করতে যোগাযোগ মনিটরিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
সংবিধান বনাম রাষ্ট্রক্ষমতা : বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- নাগরিকের নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে; চিঠিপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে; তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা যুক্তিসঙ্গত সীমাবদ্ধতা আরোপ করা যেতে পারে।
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ : ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ফোনালাপ ফাঁস ও নজরদারি সংক্রান্ত এক রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছিলেন- ‘ব্যক্তিগত বিষয়ে আড়িপাতা যেমন ঠিক নয়, তেমনি মিডিয়ায় সগৌরবে সেগুলো প্রচার করাও ঠিক নয়।’ তৎকালীন বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো: মোস্তাফিজুর রহমান।
সীমিত নজরদারি ও নাগরিক সুরক্ষার নতুন বিধান : দীর্ঘদিন ধরে দেশের জনজীবনে ফোনে আড়িপাতা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিরোধীদের বিরুদ্ধে আড়িপাতা ব্যবহার করে হয়রানি, তথ্য সংগ্রহ, এমনকি খুন-গুমের অভিযোগ ওঠার পর এটি জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
সরকার এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের খসড়া প্রস্তুত করেছে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, নাগরিকের ব্যক্তিগত ফোনে আড়িপাতা বা নজরদারি সীমিত ও কঠোর শর্তে কার্যকর হবে। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো:
- নাগরিকের জীবন বা তাৎক্ষণিক বিপদের ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে আদালতের পূর্বানুমোদনের মাধ্যমে আড়িপাতার সুযোগ রাখা হবে।
- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করতে পারবে না।
- সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তা সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চিত থাকবে।
সংশোধিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুযায়ী:
- একটি স্বাধীন কমিশন (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন) প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও সেবার উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্বে থাকবে।
- আইন অনুসারে, মধ্যস্থ সেবা প্রদানকারী, ওভার-দ্য-টপ (ওটিটি) সেবা, অনলাইন ভিডিও, স্ট্রিমিং, পেমেন্ট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মসহ সব টেলিযোগাযোগ সেবা কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
- ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী’ এবং ‘গোয়েন্দা সংস্থা’ সীমিত শর্তে আদালতের অনুমোদন নিয়ে নজরদারি করতে পারবে।
- আইনের প্রয়োগ সারা দেশে, স্থলযান, জলযান, আকাশযান, কৃত্রিম উপগ্রহ, অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিদেশ থেকে প্রাপ্ত বা বিদেশে প্রেরিত টেলিযোগাযোগ সেবায় প্রযোজ্য হবে।
- নাগরিকের অধিকার ও গোপনীয়তা সংরক্ষণের জন্য আদালতের অনুমোদন বাধ্যতামূলক।
এ আইন নাগরিক সুরক্ষা ও দেশীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রণীত। এতে নাগরিকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তা অক্ষুণœ রাখার পাশাপাশি, জরুরি পরিস্থিতিতে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত নজরদারির সুযোগ থাকবে।
এখন প্রশ্ন উঠছে- আড়িপাতা কি জাতীয় নিরাপত্তার অপরিহার্য হাতিয়ার, নাকি এটি নাগরিক অধিকারের জন্য একটি স্থায়ী হুমকি?
নতুন আইন সত্যিই নজরদারির অপব্যবহার বন্ধ করতে পারবে, নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপেই তা আবার শিথিল হয়ে পড়বে? এই টানাপড়েনের মধ্যেই বাংলাদেশের ডিজিটাল গণতন্ত্র এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।



