মাদরাসার শিক্ষাকাঠামোর সঙ্কট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা- ৫

সরকারি প্রতিষ্ঠানেই পদ শূন্য শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত

শুধু ঢাকা আলিয়া মাদরাসাই নয়, অন্য দু’টি সরকারি মাদরাসা সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা ও বগুড়ার সরকারি মুসতাফাবিয়া আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition
সরকারি আলিয়া মাদরাসা, ঢাকা
সরকারি আলিয়া মাদরাসা, ঢাকা |সংগৃহীত

দীর্ঘ দিন ধরেই সরকারি তিনটি আলিয়া মাদরাসায় বেশির ভাগ শিক্ষকের পদ শূন্য। ফলে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। নিকটাতীতে সরকারের পক্ষ থেকেই মাদরাসার সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সম্প্রতি দেশের ঐতিহ্যবাহী সরকারি মাদরাসা ঢাকা আলিয়াতে চরমভাবে শিক্ষকের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গত জুলাই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর জোর করে চেপে বসা এই মাদরাসার অধ্যক্ষ পালিয়ে গেছেন। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এ দিকে শুধু ঢাকা আলিয়া মাদরাসাই নয়, অন্য দু’টি সরকারি মাদরাসা সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা ও বগুড়ার সরকারি মুসতাফাবিয়া আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে। ঢাকা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক সঙ্কট নিয়ে সেখানকার ছাত্ররা রাস্তায় নেমে তাদের দাবি জানিয়েছেন। অবশ্য ঢাকা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক সঙ্কট দূর করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা বিভাগ থেকে শিক্ষকদের শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগিরই এই মাদরাসাসহ অন্য দু’টি সরকারি মাদরাসার শিক্ষক সঙ্কট দূর করা হবে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুধু সরকারি মাদরাসাতেই শিক্ষকদের এই সঙ্কট রয়েছে বিষয়টি এমন নয়। বেসরকারি পর্যায়ের এমপিওভুক্ত অনেক মাদরাসাতেও শিক্ষকদের এই শূন্য পদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তবে শিক্ষক সঙ্কটের অন্তরালে বেশ কিছু কারণ অনুসন্ধান করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে যেসব মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়, সেখানে রয়েছে বড় ধরনের গলদ। সূত্রমতে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় এনটিআরসিএর মাধ্যমে। যদিও এটি একটি ভালো উদ্যোগ তবে এখানে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি বা পরীক্ষা গ্রহণের মধ্যে রয়েছে কিছু ত্রুটি। সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদরাসায় আরবি প্রভাষক ও আরবি বিষয়ের জুনিয়র বা সিনিয়রসহ সব পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি সাধারণ জ্ঞান ও উচ্চতর গণিত বিষয়ে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এ প্রক্রিয়ার ভালোমানের আরবি শিক্ষক নির্বাচন করা অনেকাংশেই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে মাদরাসার মূল চাহিদা তাফসির আরবি বিষয়ের (লেকচারার) নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকের মান সন্তোষজনক হয় না।

মাদরাসাগুলোর জন্য শিক্ষক নিয়োগে যথাযথ প্রক্রিয়া, এ-সংক্রান্ত অপরাপর বিষয়ের সমস্যা এবং সমাধানের পথ বাতলিয়ে দিয়ে সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম ছিদ্দিকর রহমান নিজামী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষাবিদের মতে মাদরাসাগুলোর জন্য শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসিএর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা দরকার। তার মতে, মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য প্রিলি পরীক্ষার জন্য যেসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, সেখানে পরিবর্তন এনে বাংলায় ২০, ইংরেজিতে ২০, সাধারণ জ্ঞানে ২০ ও আরবিতে ৪০ এই সর্বমোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হলে আরবি শিক্ষকদের মেধা যাচাই করা সম্ভব হবে। কেননা মাদরাসার জন্য আরবি শিক্ষকদের জন্য আরবি ভাষা সাহিত্য, ফিকহ, উসূল, আকাইদ, তাফসির, জালালাইন, হেদায়া ও সিহাহ সিত্তাহ পাঠের জন্য উচ্চতর গণিতের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে।

ঢাকার সরকারি আলিয়া মাদরাসার একটি সূত্র জানায়, সারা দেশে মাত্র তিনটি সরকারি আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। এগুলোর ছাত্র-শিক্ষক পাঠদান পদ্ধতি সারা দেশের জন্য আদর্শ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সরকারি মাদরাসাগুলোতেই বেশি সমস্যা। ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসাতে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে প্রিন্সিপালের পদই শূন্য রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকদের মোট ৭২টি পদের মধ্যে বর্তমানে ২৮টি পদই খালি। মাত্র ৪৪ জন শিক্ষক দিয়ে কোনো মতে চলছে এখানকার পাঠদান। এই শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকে নানা কারণে ছুটিতে থাকেন। ফলে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে এখানকার পাঠদান কার্যক্রম। অন্য দিকে সিলেট আলিয়া মাদরাসা সূত্র জানায়, এখানেও মোট শিক্ষকের পদ ৬৬টি। কিন্তু বর্তমানে ৪৮টি পদই খালি। মাত্র ১৮ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে এই প্রতিষ্ঠান।

সরকারি মাদরাসাগুলোতে শিক্ষকদের এই সঙ্কট আর বেশি দিন থাকবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম।

গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, ঢাকা আলিয়া মাদরাসার জন্য ইতোমধ্যে অধ্যক্ষ পদের জন্য ঢাকা কলেজের একজন সিনিয়র অধ্যাপককে পদায়নের জন্য মনোনিত করা হয়েছে। বাকি পদগুলোতে পর্যায়ক্রমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার কাজ চলছে। অন্য দিকে সিলেট আলিয়া মাদরাসার জন্যও ইতোমধ্যে দু’জন শিক্ষককে পদায়নের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বাকি সব পদ পূরণ করা হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সচিব জানান, বেসরকারি মাদরাসাগুলোতে শূন্য শিক্ষকের পদের সংখ্যা নিরূপণের জন্য এনটিআরসিএ তথ্য সংগ্রহ করছে। সব মাদরাসার শূন্য পদের শিক্ষকের তালিকা প্রস্তুতের পর নতুন করে সার্কুলার দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। যদিও এটা চলমান প্রক্রিয়া। আশা করা হচ্ছে সব মাদারাসার শূন্য পদের শিক্ষকও দ্রুতই নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে।