আধুনিকতার স্রোতে উল্টোপথে চলছে দেশীয় সংস্কৃতি। ফলে এখন আর পালকি, ঘোড়ার গাড়ি কিংবা গরু-মহিষের গাড়িতে চড়ে গ্রামে বিয়ে উৎসব চোখে পড়ে না। কানামাছি, গোল্লাছুট, বৌচি, কুতকুত, দাড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, কাবাডি, মোরগ লড়াই, লুকোচুরি , দড়ি লাফ, এক্কা-দোক্কা, আগডুম-বাগডুম খেলাগুলো আর দেখা যায় না।
তার পরিবর্তে এখন আধুনিকতায় মাইক্রোবাস, মিনিবাস, অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাব এবং খুব যারা বিত্তশালী তারা হেলিকপ্টার, বিমানে চড়ে বিয়ে উৎসব করে। এতে করে নতুন প্রজন্ম ঝুঁকে পড়ছে যান্ত্রিক সংস্কৃতির দিকে। ফলে ক্রমাগতভাবেই বিলীন হতে চলেছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি। অন্য দিকে রেডিও ও সাদাকালো টিভির পরিবর্তে এখন মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটারে আসক্ত হচ্ছে শিশু কিশোররা। হাতের মুঠোফোনে বিশ্ব দেখছে তারা। ফলে অনেকটা বিলীন হতে চলেছে শেকড়ের সংস্কৃতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক কারণে এমনটি হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিকবন্ধন ভালো হলেও নৈতিকতার দিক থেকে আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিকৃতির পাশাপাশি অসচেতনতা আমাদের আদি সংস্কৃতি বিলীন করে দিচ্ছে ।
ঐতিহ্য বলছে, বাংলায় ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে সব কিছুরই উৎপত্তি বর্ণভেদের সংস্কৃতি থেকে। এই বর্ণভেদই আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবে তারা কোনো কদর নেই।
লোকসঙ্গীতসহ ঐতিহ্যবাহী গান আজ হুমকির মুখে। এসবের জায়গায় এখন চর্চা করা হচ্ছে পাশ্চাত্য ধারার গানগুলো। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ঐতিহ্যকে ছাপিয়ে বাঙালিদের পোশাকে বেশ পরিবর্তন এনেছে। মানুষ এখন চলতে ফিরতে ঐতিহ্য থেকেও বেশি গুরুত্ব দেয় ফ্যাশনের দিকে। লুঙ্গি, পাঞ্জাবি বা শাড়ির পরিবর্তে এখন গোলগলা টি-শার্ট, শার্ট, ফতুয়া, পায়জামা, জিন্স প্যান্ট থ্রীপিস ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মিশে গিয়ে দেশীয় সাজ ভুলতে শুরু করেছে এখনকার প্রজন্ম।
অন্য দিকে প্রযুক্তির যন্ত্রসঙ্গীতের আড়ালে গ্রামীণ সংস্কৃতির সেই ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গানগুলো কৃষক ও রাখালদের মাঝে শোনা যায় না। শোনা যায়, না রাখালের বাঁশির সেই মনটানা সুর। কমেছে বিশাল চরে রাখালের গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার পাল চরানো। মহিষের পিঠে রাখালের সওয়ার। দলবেঁধে পথচলা গরু-মহিষের দীর্ঘ সারি। তার বদলে এখন মানুষের চাহিদায় দাবি ব্রান্ডের সব বাহন। আগে ভোর হলেই কৃষকদের লাঙ্গল-জোয়াল, মই কাঁধে নিয়ে ছুটতে হতো ক্ষেত-খামারে। জমিতে গরু-মহিষের কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল বেঁধে টানা দুপুর পর্যন্ত চাষ করা হতো। এখন তার পরিবর্তে ট্রাক্টর, সেলোমেশিন দ্বারা জমি চাষ করা হচ্ছে।
এভাবে করে সভ্যতার ক্রম বিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ অবকাঠামোগুলোর চিত্রও পাল্টে গেছে। গ্রামের প্রায় বাড়িগুলো এখন ইটের দেয়াল, টিনশেড দ্বারা নির্মিত হচ্ছে। ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক আলোর ছটা। এভাবেই আধুনিকতার স্রোতে বিলুপ্তির পথে এখন দেশীয় সংস্কৃতি।