বিদেশে বৈধভাবে শ্রমিক পাঠাতে হলে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিকরাও নানা কৌশলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। তারপরও সাতটি ট্র্যাভেল এজেন্সি ‘বিশেষ থার্ড পার্টি’ হিসেবে বিদেশে ক্লিনার, কন্সট্রাকশন লেবারসহ বিভিন্ন ভিসায় লোক পাঠানোর কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করেছে। এমন অভিযোগ পেয়ে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) অনুসন্ধানে নেমে এর সত্যতা পায়। এরপরই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংস্থার পক্ষ থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে (এনফোর্সমেন্ট শাখা) একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এমন প্রতিবেদন পাওয়ার পরই মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স সদস্যরা নড়েচড়ে বসেন।
গতকাল রোববার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স থেকে অবৈধ সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দেয়া হয়। জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেকোনো সময় মোবাইল কোর্টের অভিযান শুরু হচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই এনএসআই থেকে একটি গোপন প্রতিবেদন পাঠানো হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। তারই আলোকে ব্যুরোতে মন্ত্রণালয়ের (এনফোর্সমেন্ট শাখা-৩) সিনিয়র সহকারী সচিব কাফী বিন কবির স্বাক্ষরিত ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার’ বিষয়ে ওই চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে ফ্লাই গ্যাল্যাক্সি ট্যুরিজম, মাহিদুল ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস, এফএস ট্র্যাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, কে এফ ট্র্যাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস ওপিসি, এআর ট্র্যাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, অ্যালফোর্ড ইন্টারন্যশানাল লিমিটেড, সুমি ভিসা অপরচুনিটি নামের সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশে কর্মী পাঠানোর বৈধ কোনো লাইসেন্স নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ থার্ড পার্টি হিসেবে বিদেশে ক্লিনার, ফুড ডেলিভারি, ইনডোর-আউটডোর সার্ভিস, কন্সট্রাকশন লেবার ইত্যাদি ভিসায় বিদেশে পাঠানোর কথা বলে অর্থ নেয়। এ ছাড়া ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকায় ওয়ার্কিং ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায়, পর্তুগাল, গ্রিস, নর্থ মেসিডোনিয়ায় পাঠানোর কথা বলে অর্থ নিয়ে থাকে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কর্মীদের কাছ থেকে লাইসেন্স-প্রাপ্ত ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে বিমানের টিকিট, হোটেলে বুকিং বা রিসোর্ট বুকিং করে থাকে। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে যাত্রীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নির্ধারিত মন্ত্রণালয়, বিভাগের অনুমোদিত না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও ভুক্তভোগীরা কোনো সমাধান পান না বা তাদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করাও যাচ্ছে না।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালকের কাছে দেয়া চিঠিতে আরো বলা হয়, এই অবস্থায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনাপূর্বক এনএসআই কর্তৃক পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লিখিত অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
উল্লেখ্য, শুধু এই সাতটি এজেন্সিই নয়, ট্র্যাভেল এজেন্সির সাইনবোর্ড লাগিয়ে নামসর্বস্ব অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপ-সহ নানা মাধ্যমে মুখরোচক বিজ্ঞাপন দিয়ে দেদার বিদেশগামীদের সাথে প্রতারণা করছে। এদের খপ্পরে পড়ে ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন দেশের কারাগারে এখনো বন্দী হয়ে আছেন। আবার অনেকে ইইরোপের দেশ ইতালির স্বপ্ন দেখে লিবিয়া হয়ে সাগরপথে পাড়ি দিয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছেন। তারপরও প্রতারক চক্রের প্রতারণা কোনোভাবেই থামছে না। অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের (টাস্কফোর্স) সদস্যদের আরো সক্রিয় হতে হবে। নতুবা প্রতারণার হার দিন দিন আরো বাড়তে থাকবে বলে এই পেশার সাথে জড়িতরা মনে করছেন।
গতকাল রোববার জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে নিজের পরিচয় না জানিয়ে শুধু বলেন, মোবাইল কোর্টের অভিযান আমরা যেকোনো সময় শুরু করব। ইতোমধ্যে যারা এসব কাজে লিপ্ত তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরুর কোনো বিকল্প নেই। কারণ এদের কারণে অনেকেই আজ পথে বসে গেছেন। আর এই চক্রের সাথে বেশির ভাগ ট্র্যাভেল এজেন্সির সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। যদিও সম্প্রতি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় অবৈধ প্রায় ২০ হাজারের মতো ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিস রয়েছে বলে খোঁজ পেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলেও তারা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে।