নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের শেয়ারবাজার আবার পতনের বৃত্তে পড়েছে। সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবস ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বড় ধরনের দরপতন দেখা গেছে। বাজারে মন্দাভাব ছড়িয়ে পড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। একইসাথে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) সূচক ও লেনদেন উভয়ই কমেছে। গতকাল দিনশেষে দেখা গেছে, ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া কোম্পানিগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশের শেয়ারের দর কমে গেছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক করপোরেট ঘোষণা, বিশেষ করে আইটি খাতের কিছু কোম্পানির ‘নো ডিভিডেন্ড’ প্রকাশ ও বীমা খাতে মুনাফা হ্রাসের প্রভাব বাজারে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করেছে।
গতকাল ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় ৫,০৬১ পয়েন্টে। আগের কার্যদিবসে এই সূচক কমেছিল ৬ পয়েন্ট। একইদিন ডিএসইএস সূচক কমেছে ১২.৩৬ পয়েন্ট এবং ডিএস-৩০ সূচক ২১.৯৪ পয়েন্ট কমে ১,৯৬০ পয়েন্টে নেমে এসেছে। দিন শেষে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা আগের কার্যদিবসের ৫৪৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ কম। বিশ্লেষকদের মতে, ক্রেতা অনুপস্থিত থাকায় এবং বিনিয়োগকারীদের মুনাফা তুলে নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় লেনদেনে এই পতন ঘটেছে। এদিন ডিএসইতে ৩৯৮টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে ৪৫টির দর বেড়েছে, ৩০০টির কমেছে এবং ৫৩টির দর অপরিবর্তিত ছিল।
এ দিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও দিনটি ছিল নেতিবাচক। সিএএসপিআই সূচক ১৪ হাজার ২১৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে, যা আগের দিনের তুলনায় ৩১ পয়েন্ট কম। লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার, যেখানে আগের দিন ছিল ১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকার। সিএসইতে মোট ১৯৩টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়, যার মধ্যে ৩৫টির দর বেড়েছে, ১৩৩টির কমেছে এবং ২৫টির দর অপরিবর্তিত ছিল।
এ দিকে গতকাল দর বৃদ্ধির শীর্ষে উঠে এসেছে ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর বেড়েছে ৫ টাকা ২০ পয়সা বা ৭.০৯ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেড, যার শেয়ারদর বেড়েছে ১০ টাকা ৭০ পয়সা বা ৬.৬৯ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে ছিল সিএপিএম বিডিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান, যার দর বেড়েছে ৭০ পয়সা বা ৬.৩১ শতাংশ। শীর্ষ দশে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এসিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ, ফিনিক্স ফাইন্যান্স প্রথম মিউচুয়াল ফান্ড, রিং শাইন টেক্সটাইল ও সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি।
গতকাল দরপতনের তালিকায় শীর্ষে ছিল ফারইস্ট ফাইন্যান্স, যার শেয়ারদর ১০ শতাংশ কমেছে। পরবর্তী অবস্থানে ছিল প্রিমিয়ার লিজিং, তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল, প্রগতি লাইফ, এ. আলম কোল্ড রোল্ড, আইএফআইএল ফান্ড, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, রেনউইক, গোল্ডেন সন ও ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ।
এ দিকে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষে ছিল সামিট এলায়েন্স পোর্ট লিমিটেড, যার ২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে ছিল আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, তৃতীয় স্থানে ওরিয়ন ইনফিউশন। শীর্ষ দশে আরো ছিল সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং, খান ব্রাদার্স ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ, সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল, এসিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ও প্রগতি লাইফ ইন্সুরেন্স।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাজারে নেতিবাচক মনোভাবের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কিছু কোম্পানির ডিভিডেন্ড না দেয়া। তালিকাভুক্ত ১১টি আইটি কোম্পানির মধ্যে সাতটি এখন পর্যন্ত ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ড্যাফোডিল কম্পিউটার লিমিটেড ও ইনটেক লিমিটেড এ বছর কোনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি যা বিনিয়োগকারীদের হতাশ করেছে।
ড্যাফোডিল কম্পিউটার গত বছর ৫ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল, কিন্তু এবার ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করেছে। কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৬ পয়সা, যা আগের বছরের ২১ পয়সা থেকে কমেছে। অন্য দিকে, ইনটেক লিমিটেডও এবার ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি বরং প্রতি শেয়ারে ৩৮ পয়সা লোকসান দেখিয়েছে। ফলে প্রযুক্তি খাতের সামগ্রিক চিত্র বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত করেছে। এ দিকে বীমা খাতেও মুনাফা কমার প্রবণতা দেখা গেছে। ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড (টিআইএলআইএল) তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৫) আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার ঘাটতি দেখিয়েছে, যদিও আগের বছর একই সময়ে কোম্পানিটি ৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকার উদ্বৃত্তে ছিল। তবে ৯ মাসের হিসেবে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২৫) কোম্পানিটি উদ্বৃত্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে মোট ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মুনাফা কমলেও কোম্পানির লাইফ ইন্স্যুরেন্স ফান্ডের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা এক বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকার প্রবৃদ্ধি। বিশ্লেষকদের মতে, এটি কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ইতিবাচক সঙ্কেত।
বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, আইটি খাতের ডিভিডেন্ড সঙ্কট, আর্থিক খাতে মুনাফা হ্রাস এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে তারল্য সঙ্কটের কারণে শেয়ারবাজারে আস্থা কমে গেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা নতুন পুঁজি ঢালতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ডিএসই ব্রোকারেজ সূত্র জানায়, বিনিয়োগকারীরা এখন মূলত লাভ তোলার কৌশল নিচ্ছেন, নতুন করে ঝুঁকি নিচ্ছেন না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেছে, যার কারণে দিনের শেষে বাজারে বিক্রির চাপ বেড়েছে। তবে বিশ্লেষকদের পরামর্শ, বর্তমান সময় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য বাছাইকৃত মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ার ধরে রাখার উপযুক্ত। বাজারের এই মন্দাভাব সাময়িক বলে মনে করছেন তারা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গতকাল লেনদেন শেষে সূচক ও লেনদেন উভয়ই ছিল নি¤œমুখী। দিনশেষে প্রায় বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে এবং আইটি ও বীমা খাতের দুর্বল পারফরম্যান্স বাজারে হতাশা বাড়িয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মৌলিক ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরলে বাজারে দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরতে পারে।
 


