উপদেষ্টার পোস্টে আপত্তি জানানো উপদেষ্টাদের তালিকা ফাঁস

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান গতকাল শুক্রবার ফেসবুকে একটি বিস্ফোরক পোস্ট দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার সাথে কয়েক দিন আগে সাক্ষাৎ করে বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি কয়েকজন উপদেষ্টার ব্যাপারে তাদের আপত্তি প্রদানের কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু কোনো দলের পক্ষ থেকেই সেই উপদেষ্টাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। গতকাল উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান বিতর্কিত উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করে দিয়েছেন। যে উপদেষ্টাদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি তাদের মধ্যে তিনিও একজন। ফওজুল কবির খান উপদেষ্টাদের নিয়ে বিতর্ক এড়াতে তাদের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কোনো পদে না থাকার বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপের প্রস্তাব করেছেন।

উপদেষ্টা ফৌজুল কবির খান পোস্টে বলেছে, ‘একটি তালিকায় আমার নামও রয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে শুধু এই টুকুই বলা যে, আমি পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তা করতে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত নই। সবসময় কোনোরূপ অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবুও প্রশ্ন যেহেতু উঠেছে এর নিষ্পত্তি করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাবৃন্দ, বিশেষ সহকারীবৃন্দ, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োজিত সব কর্মকর্তার কেউই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের (যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন) কোনো লাভজনক পদে কেউই অংশ নিতে পারবেন না এই মর্মে একটি অধ্যাদেশ জারি করলে এ সমস্যার সুরাহা হতে পারে বলে আমি মনে করি। তবে শর্ত থাকে যে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে যারা অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন তাদের ক্ষেত্রে উপরি উক্ত বিধান প্রযোজ্য হবে না।’

কারা সেই বিতর্কিত উপদেষ্টা?

উপদেষ্টা ফওজুল কবির খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী খোদা বক্স চৌধুরী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। তারা দায়িত্বে থাকলে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করবেন বলে বিএনপি মনে করছে। তাই বিএনপি তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য বলেছে।

জামায়াতে ইসলামী উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমদ এবং উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। আসিফ নজরুল উপদেষ্টা পরিষদের সবচেয়ে সমালোচিত উপদেষ্টা। তাকে একটি প্রতিবেশী দেশের এজেন্ট হিসেবে মনে করা হয়। তিনি জামিন বাণিজ্য, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকদের একচেটিয়া প্রাধান্য দিয়েছেন বলেও জামায়াতের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমদ ও ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের ক্লাসমেট। তারা নিয়মিত এক জায়গায় আড্ডা দেন, প্রতিদিন মির্জা ফখরুলের সাথে ফোনে কথা বলেন। ড. সালেহ উদ্দিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদে এবং জনপ্রশাসনেরও উচ্চতর পদগুলোতে বিএনপিপন্থী লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন। ড. ওয়াহিদ উদ্দিন শিক্ষা উপদেষ্টা থাকাকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের উপাচার্য ও উপ উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছেন। জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য আদর্শের শিক্ষকদের তিনি উপেক্ষা করেছেন। তাই জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়েছে।

এনসিপির আপত্তির লিস্ট একটু লম্বা। তারা চারজন উপদেষ্টা এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। জামায়াতের আপত্তির সাথে এনসিপির মিল রয়েছে। জামায়াতের মতো এনসিপিও ড. আসিফ নজরুল, ড. সালেহ উদ্দিন ও ড. ওয়াহিদ উদ্দিনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। এনসিপি উপদেষ্টা আদিলুর রহমানের ব্যাপারেও আপত্তি জানিয়েছে।

কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে- বিএনপি ইতঃপূর্বে এনসিপির সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করলেও এখন সেই দাবি থেকে সরে এসেছে। এনসিপির সাথে সাম্প্রতিক আসন ভাগাভাগি বা জোট গঠনের আলোচনার কারণেই হয়তো বিএনপি আসিফ আর মাহফুজের ব্যাপারে আর আপত্তি দেয়নি।

আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, খোদা বক্স চৌধুরীর ব্যাপারে বিএনপির আপত্তি। খোদা বক্স বিএনপি আমলে আইজিপি ছিলেন। সেই কারণে তাকে জেল-জুলুমও খাটতে হয়েছে। তারপরও তার ওপর অনাস্থা কেন? খোদা বক্স বর্তমানে যেভাবে পুলিশ প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করছেন তা সম্ভবত বিএনপির পছন্দ হচ্ছে না। তিনি বিএনপির চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। তাই তার বিরুদ্ধে অনাস্থা। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে- মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদের ব্যাপারে বিএনপির আপত্তি। শেখ আব্দুর রশীদ একজন পেশাদার, মেধাবী ও দক্ষ আমলা হিসেবে পরিচিত। ফ্যাসিস্ট রেজিমে পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। বিগত রেজিমেই তার মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার মধ্যে কোনো আওয়ামী ফ্লেভার না থাকায় তাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব তো দূরের কথা সচিবও করা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে নিয়োগ দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে দলবাজি বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ কখনো উঠেনি। তা সত্ত্বেও বিএনপি কেন তাকে আস্থায় নিতে পারছে না! বিএনপি কি তাহলে শেখ আব্দুর রশীদের পরিবর্তে কোনো বিএনপিপন্থী সচিবকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বানাতে চায়? প্রধান উপদেষ্টার সাথে তিন রাজনৈতিক দলের বৈঠকে উপদেষ্টদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে।