দূষণ রোধে পোড়া বর্জ্যে ফের ছড়াচ্ছে বিষ

আবুল কালাম
Printed Edition

রাজধানীর প্রধান সড়কের আশপাশে জমে থাকছে ময়লার পাহাড়। তা থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন অমান্য করে বর্জ্য পুড়িয়ে ফের দূষিত করা হচ্ছে পরিবেশ। এতে বাতাসে ফের ছড়াচ্ছে বিষ। ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক ঝুঁকির সাথে বায়ু ও মাটি দূষিত করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের অসহযোগিতা, নির্মাণকাজে আইন না মানা এবং অনিয়ন্ত্রিত ইটভাটা ও ভিনদেশী দূষণে ভেস্তে যাচ্ছে সব উদ্যোগ। ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রণে শাস্তিতেও স্বস্তি মিলছে না।

পরিসংখ্যান বলছে, বিগত প্রায় ৯ বছরে অর্থাৎ তিন হাজার ২৪০ দিনে ঢাকা দূষণমুক্ত ছিল মাত্র ৬০ দিন। বাকি তিন হাজার ১৮০ দিন দূষণে নগরে ছিল বসবাসের অযোগ্য। অথচ নগরীর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশকে বসবাসে সহায়ক রাখতে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদফতর থাকলেও বাস্তবে তারা এর কার্যকর ব্যবস্থায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে বছরের পর বছর পরিবেশ খাতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের পরও এরা দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি।

গবেষকরা বলছেন, বর্জ্য পোড়ানোয় কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ অন্তত ছয়টি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সড়কে পড়ে থাকা ময়লায় প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণে ডাই-অক্সিন, ফুরান, মার্কারি, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলের মতো বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হয়। এতে মানুষের বিভিন্ন শ্বাসতান্ত্রিক রোগ তৈরি করে। কার্বন মনোক্সাইড রক্তে প্রবেশ করে হিমোগ্লোবিনে অক্সিজেন পরিবহনে বাধা দিয়ে কিডনি, লিভার ও ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া বস্তুকণা ফুসফুসে জমা হয়ে নিমোকোনোওসিস নামের একটা রোগ তৈরি করে। ফলে পুরো ফুসফুস শুকিয়ে যায়। তখন আইএলডি (ইন্টারসটিশিয়াল লাং ডিজিজ) সৃষ্টি হয়।

সিটি করপোরেশন বলছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নগরীতে রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে আবর্জনার স্তূপ তৈরির পর তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ একাধিক বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়।

অথচ বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বলছে বর্জ্যে বা তার কোনো অংশ যত্রতত্র খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ বা পোড়ানো নিষেধ। বিধিমালায় বলা আছে, রাস্তা, সড়ক, মহাসড়কের পাশে কোনো অবস্থায় বর্জ্য পোড়ানো যাবে না। এটি ভঙ্গ করলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর ভাষ্য, বায়ুদূষণ রোধে সরকার প্রায় পাঁচ বছর আগেই দু’টি প্রকল্পে অন্তত সাড়ে ছয় কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। এ ছাড়া দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে আরো একটি প্রকল্প চলমান আছে। কিন্তু এই বিপুল ব্যয়ে ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় বারবার উঠে আসছে ঢাকার নাম।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধীন বায়ুদূষণ গবেষণা কেন্দ্র (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানো নিয়ে প্রায় পাঁচ বছর তারা গবেষণা করেছেন। এতে ঢাকার ২৩টি জায়গায় বেশি ময়লা পোড়ানোর তথ্য উঠে আসে। ফলে এক দিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়া বাতাসে মিশে বিষ চড়াচ্ছে। তার ভাষ্য, প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২ শতাংশ করে বায়ুদূষণের পরিমাণ বাড়ছে। এর মধ্যে আন্তঃমহাদেশীয় বায়ুদূষণ ৩০ ভাগ, রান্নার লাকড়ি ২৮ ভাগ, বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৪ ভাগ, ইটভাটা ১৩-১৫ ভাগ, নির্মাণকাজ ১১ ভাগ, বর্জ্য পোড়ানো ১১ ভাগ এবং যানবাহন পাঁচ ভাগ দেশের বাতাসকে দূষিত করছে।

অন্য দিকে গত বছর নভেম্বরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের “ক্লিয়ারিং দ্য এয়ার : অ্যাড্রেসিং বাংলাদেশ’স এয়ার পলিউশন ক্রাইসিস” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণে উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানোর অবদান ১১ শতাংশ। কিন্তু এত বছর পরও দূষণের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আরো বেড়েই চলছে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে সম্প্রতি মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিল পরিদর্শনে গিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বর্জ্য না পোড়ানোর নির্দেশনা দেন। বর্জ্য পোড়ানোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু কথা জানিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যদি কার্যকরভাবে করা না যায়, তা হলে ঢাকাবাসীকে বায়ুদূষণের হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।

বিশিষ্ট চিকিৎসক বিএমইউর প্রোভিসি (প্রশাসন) ও ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা: মো: আবুল কালাম আজাদ নয়া দিগন্তকে বলেন, পুড়ানো বর্জ্যরে দূষণে সবচেয়ে বেশি মানুষ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে। দূষিত পরিবেশে খুব প্রয়োজন ছাড়া শিশু ও বয়স্করা ঘরের বাইরে না যাওয়াটা উত্তম। একান্ত প্রয়োজন হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ‘বিষাক্ত গ্যাস শ্বাসতন্ত্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।