বিরূপ হয়ে উঠছে প্রকৃতি

আবুল কালাম
Printed Edition

বিরূপ হয়ে উঠছে প্রকৃতি। শরৎকালে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাওয়ার বদলে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে কালো মেঘ। বর্ষার বৃষ্টি ঝরেছে শরতে। ঋতু বদলের নিয়মে মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর মাসে হেমন্ত থাকার কথা; কিন্তু অব্যাহত পরিবেশদূষণের ফলে বিগত কয়েক বছর ধরে এ নিয়মের বলয় ভাঙতে শুরু করেছে। উন্নয়ন সংস্থা ‘কারিতাস বাংলাদেশ’ বলছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এমনটি হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে দেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

ভারসাম্য নষ্টের কারণে প্রকৃতির এমন অস্বাভাবিকতা উল্লেখ করে ক্লাইমেট সেন্ট্রালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাধার ভরাট, বন ধ্বংস, অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ নষ্ট করেছে। এতে অসহনীয় বায়ুদূষণের সাথে তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ঢাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে পরিবেশদূষণও বাড়ছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, দিন দিন আবহাওয়া বদলে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা। বর্তমানে মূলত গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত- এ তিন ঋতুর মধ্যে আবহাওয়া আবর্তিত হচ্ছে। অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। এ ছাড়া বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, ভয়াবহ যানজট, পয়োনিষ্কাশনের করুণ অবস্থা, জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের করুণ দশা পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

পরিবেশ ধ্বংসের কারণ এবং অবস্থা উল্লেখ করে একাধিক সংস্থা তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) বলছে, গত ৯ বছরে ঢাকার মানুষ ৬২৪ দিন মাঝারি বায়ু, ৮৭৮ দিন সংবেদনশীল বায়ু পেয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গত ৯ বছরের মধ্যে ঢাকায় ২০২৩ এবং ২০২১ সালে খুব অস্বাস্থ্যকর বায়ুমানের দিনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এ সময়ে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বায়ুতে মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। এসব কারণেই প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন বলছে, দেশে পাখি বিলুপ্তির সাথে উদ্ভিতের বিস্তার কমছে। দুই দশকে দেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে ছয় লাখ একর। আর নিরাপদ আবাসনের অভাব, বন উজাড়, বিষযুক্ত খাদ্য, বৃক্ষ কেটে স্থাপনা তৈরি এসব নানান কারণে পাখি কমছে। অন্য দিকে ৭১৫ প্রজাতির পাখির মধ্যে ঝুঁকিতে রয়েছে ৫০ প্রজাতি। এসব কারণে প্রকৃতিকভাবে বিজের বিস্তার কমে যাওয়ায় নতুন গাছ বাড়ছে না। ফলে দিন দিন বৃক্ষহীন হয়ে পড়া পরিবেশ মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা বলছে, ৮৯ সাল থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে ঢাকায় আরো ৩৫ শতাংশ এলাকায় উত্তাপ বেড়েছে। অর্থাৎ বছরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে ১ শতাংশের বেশি এলাকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৯ সালে যেখানে ঢাকার ৩০ শতাংশ এলাকা তপ্ত ছিল সেখানে ২০১৪ সালে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ দুই যুগে উত্তাপ ছড়িয়েছে ৩০ শতাংশ এলাকায়, যা এখনো অব্যাহত আছে।

এ বিষয়ে পরিবেশবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত প্রকৃতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে। তার কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, গত এক দশকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমনের হার বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে গ্রীষ্মকালে ফসলের চাষাবাদ বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করা মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠবে। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ সবসময় দুর্যোগপ্রবণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ভুক্তভোগীদের অন্যতম বাংলাদেশ। যার কারণে প্রকৃতি এখন বদলাতে শুরু করেছে।

কার্বন নিঃসরণ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশ মাত্র দশমিক শূন্য চার এক ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে, যা দেশের লোকসংখ্যার তুলনায় খবুই ন্যায্য; কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রগুলো যে পর্যায়ে কার্বন নিঃসরণ করে আজকে উন্নত হয়েছে সেগুলো খুবই উদ্বেগজনক। সার্বিকভাবে বলা যায় বৈশিক জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ কোনোভাবে দায়ী না হয়েও পৃথিবীর সবচেয়ে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত একটি রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, যার প্রভাব এখন আমরা দেখছি।

অপর দিকে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক নয়া দিগন্তকে বলেন, এলনিনোর প্রভাবে সারা পৃথিবীতে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তার মতে, এভাবে উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকলে গাছপালা বিলীন এবং শস্য আবাদে চরম ঘাটতি দেখা দিতে পারে।