বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষে নিয়োগ পাওয়া এক হাজার ২০০ কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করার নেপথ্যে জালজালিয়াতি ছাড়াও কোটি কোটি টাকা হাতবদল হওয়ার অভিযোগে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগে যাদের নাম এসেছে তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে চিঠি দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ফায়ার) ও অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা আবু সালেহ মো: খালেদ স্বাক্ষরিত পৃথক একাধিক চিঠি সিভিল এভিয়েশনের উপ-পরিচালক (মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সাধারণ প্রশিক্ষণ) মোহাম্মদ আবিদুল ইসলাম, পরিচালক (অডিট) মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী (প্রশাসন) মো: রোকনুজ্জামান ও সহকারী সমন্বয় কর্মকর্তা (প্রশাসন) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামের কাছে দেয়া হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষাৎকার দেয়া প্রসঙ্গে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দৈনিকভিত্তিক কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ী করার সময় নতুন করে বয়স কমিয়ে ভুয়া এনআইডি কার্ড বানিয়ে চাকরিতে যোগদান করানো হয়েছে। এই অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত দিন-তারিখ অনুযায়ী সিভিল এভিয়েশন সদর দফতরের লেভেল ৩, পরিচালকের (ফায়ার) দফতর রুম নম্বর ৩২৭-এ উপস্থিত হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়। এর মধ্যে কাউকে ৪ সেপ্টেম্বর আবার কাউকে ৭ সেপ্টেম্বর উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
গত রোববার এ বিষয়ে জানতে তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিচালক (ফায়ার) আবু সালেহ মো: খালেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তের প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর বলেন, আপনি এখন কোথায়? ঢাকায় জানালে বলেন, আপনি আমার অফিসে এসে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। সিভিল এভিয়েশনের কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ী করার সময় নতুন করে বয়স কমিয়ে ভুয়া আইডি কার্ড বানিয়ে চাকরিতে যোগদান করানোর অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আপনি তদন্ত শুরু করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ফোনে কথা বলা যাবে না, আপনি অফিসে আসেন, সামনা সামনি কথা বলতে হবে। এর আগে বয়স কমিয়ে ভুয়া এনআইডি কার্ড বানিয়ে চাকরিতে যোগদান করানোর বিষয়ে রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দরের জনৈক শাহ সুলতান সবুজ স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ জমা পড়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। ২০২৪ সালের ৩ মার্চ এমন অভিযোগ পাওয়ার পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। এ নিয়ে শুরু হয় চিঠি চালাচালি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গত ৪ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার দফতরে উপস্থিত হতে বলা হয়। একই সাথে অভিযোগের অনুলিপি পাঠানো হয় দুর্নীতি দমন কমিশন সেগুনবাগিচায়।
অভিযোগকারী তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, বেবিচক-এর প্রশাসন শাখা দৈনিকভিত্তিক এক হাজার ২০০ কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী করেছে। এটি করার ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার ঘুষবাণিজ্য হয়েছে। যে যত ঘুষ দিতে পেরেছে তাদের পদের গ্রেড সেই অনুপাতে উচ্চতর হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে ২০তম গ্রেড চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ক্ষেত্রে। বলা হয়েছে, দৈনিকভিত্তিক হিসাবে বেবিচকে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী অনেকেই ২০ থেকে ২৫ বছর চাকরি করেন। তারপরও তাদের চাকরি স্থায়ী করার সময় মোটা অঙ্কের ঘুষ নেন প্রশাসন শাখার কর্মকর্তারা। একপর্যায়ে কর্মকর্তারা এসব কর্মচারীর বয়স কমিয়ে নতুনভাবে চাকরিতে স্থায়ীকরণ করে যোগদান করানো হয় বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- অফিস সহায়ক মো: সাহিন মিয়া, মো: মানিক মিয়া, শাহাবুদ্দিন, মো: রফিক, গাজী মতিউর রহমান এবং প্লাম্বার মিস্ত্রী মো: কাজল মিয়া প্রমুখ। এসব কর্মচারীর প্রত্যেকেই প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীদের অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করেন। তাদের প্রত্যেকেরই ভোটার আইডি কার্ড ভুয়া, বয়স কমিয়ে বানানো হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। গুরুতর অভিযোগের মধ্যে আরো রয়েছে, যাদেরকে বয়স কমিয়ে চাকরিতে যোগদান করানো হয়েছে তাদের (চতুর্থ শ্রেণী) অষ্টম শ্রেণীর দেয়া সার্টিফিকেটটিও ভুয়া। বাস্তবে তারা কেউই পড়ালেখা জানে না। কোনোভাবে শুধু নিজেদের নাম লিখতে পারে। তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের ওপর পরীক্ষা নিলে কোনো কিছু লিখতে পারবে না। তারপরও তাদের চাকরিতে স্থায়ী করার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন সাবেক সদস্য (প্রশাসন) মিজানুর রহমান, যুগ্ম সচিব (পরিচালক প্রশাসন) মো: জহিরুল ইসলাম, পরিচালক মানবসম্পদ উন্নয়ন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক প্রশাসন মোহাম্মদ আবিদুল ইসলাম, নিম্নমান সহকারী রোকনুজ্জামান, জাহিদুল ইসলাম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো: মোমিনুল ইসলাম প্রমুখ।
চাকরি স্থায়ী করার সময় এসব কর্মকর্তা শত শত কোটি টাকা ঘুষবাণিজ্য করেছেন। অভিযোগে দাবি করা হয়, কর্মচারীদের দৈনিকভিত্তিক হিসাবে নিয়োগপত্র খুঁজে বের করলে তাদের প্রত্যেকের প্রকৃত বয়স বের হয়ে আসবে। এ ছাড়া এসব কর্মচারীর প্রত্যেকেই ঠিকাদারি পেশার সাথে জড়িত। যাদের অধীনে তারা অফিস সহায়কের ডিউটিতে নিয়োজিত, সেসব প্রকৌশলীর প্রত্যেকেই তাদের অফিস সহায়ককে বছরে লাখ লাখ টাকার কাজ দিয়ে সহায়তা করেছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে তারা প্রত্যেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অভিযোগে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে।