আমদানিনির্ভর কয়লা ও এলএনজি ব্যবস্থার মধ্যে আটকে যাচ্ছে দেশ

সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা অবিলম্বে বাতিল ও নতুন সব জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্প বন্ধের দাবি জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের

আইইপিএমপি বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে আমদানিনির্ভর কয়লা ও এলএনজি ব্যবস্থার মধ্যে আটকে দিচ্ছে, যা একদিকে জলবায়ু সঙ্কট তীব্র করছে, অন্য দিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি বহুগুণ বাড়াচ্ছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

জলবায়ু সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর উন্নয়নের পথ থেকে সরে আসার স্পষ্ট আহ্বান জানালেন দেশের জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী ও দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) অবিলম্বে বাতিল, সব নতুন জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্প বন্ধ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দ্রুত ও ন্যায়ভিত্তিক রূপান্তরের দাবি জানিয়ে ৮ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে তৃতীয় জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ ২০২৫।

গতকাল রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী এ সমাবেশের সমাপনী অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেয়া হয়। সমাবেশে উপকূল, হাওর, চর ও বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে আসা জেলে, কৃষক, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, নারী, যুব, পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীসহ মোট এক হাজার ৯৪৫ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে জলবায়ু পরিবর্তন, শিল্পায়ন ও জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাব তুলে ধরেন।

সমাপনী দিনে প্রকাশিত ঘোষণাপত্রে বলা হয়, আইইপিএমপি বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে আমদানিনির্ভর কয়লা ও এলএনজি ব্যবস্থার মধ্যে আটকে দিচ্ছে, যা একদিকে জলবায়ু সঙ্কট তীব্র করছে, অন্য দিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকি বহুগুণ বাড়াচ্ছে।

৮ দফা ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) সদস্য সচিব শরীফ জামিল। এতে সভাপতিত্ব করেন জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-২০২৫-এর আহ্বায়ক ড. মুজিবুর রহমান। ঘোষণাপত্রে আইইপিএমপির পাশাপাশি মহেশখালী-মাতারবাড়ী উন্নয়ন উদ্যোগের (এমআইডিআই) মতো মেগা শিল্প পরিকল্পনাগুলোকে বাংলাদেশের জলবায়ু বাস্তবতার সাথে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এসব পরিকল্পনা কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে এবং জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

শরীফ জামিল বলেন, আইইপিএমপি ও এমআইডিআই পরিকল্পনাগুলো ব্যয়বহুল আমদানিকৃত কয়লা ও এলএনজি নির্ভরতা বাড়াচ্ছে, অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি পেমেন্টের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে এবং জনগণকেন্দ্রিক নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ভবিষ্যৎকে দুর্বল করছে। তিনি বলেন, বিদ্যমান বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করে অলস কেন্দ্রগুলোর জন্য বিপুল ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে, যা স্পষ্টতই জনস্বার্থবিরোধী।

সমাবেশে নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, বায়ু ও পানি দূষণ, বন উজাড় এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির সম্প্রসারণ ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এসব সঙ্কটকে আরো তীব্র করছে এবং মানুষের জীবিকা ও পরিবেশ ধ্বংস করছে। সুন্দরবনসহ ম্যানগ্রোভ বন সংরক্ষণ, দূষিত নদী পুনরুদ্ধার, শিল্প দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে ভূমিদখল ও দুর্নীতির জন্য জবাবদিহি নিশ্চিতের দাবিও উঠে আসে।

ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভের কৌশলগত উপদেষ্টা হারজিৎ সিং বলেন, জলবায়ু ন্যায্যতা কেবল রাষ্ট্রের মধ্যে নয়, রাষ্ট্রের ভেতরের বৈষম্য ও বেছে নেয়া উন্নয়ন মডেলের সাথেও সরাসরি সম্পর্কিত। তিনি গ্লোবাল নর্থের ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন পথ প্রত্যাখ্যান করে মানুষ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানান এবং জাতীয় ও দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেন।

সমাবেশের সহ-আহ্বায়ক এম এস সিদ্দিকী বলেন, রামপাল প্রকল্পসহ যেসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে আগে আপত্তি জানানো হয়েছিল, সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব এখন স্পষ্ট। তরুণদের সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অর্থবহভাবে যুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক আইনি দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

তৃতীয় জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-২০২৫ আয়োজন করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)। জাতীয় সহ-আয়োজকদের মধ্যে ছিল ব্রাইটার্স, ব্রতী, সিপিআরডি, কোস্ট ফাউন্ডেশন, ক্রেসল, মিশন গ্রিন বাংলাদেশ, ওএবি ফাউন্ডেশন ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে ছিল এপিএমডিডি, ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভ, ফসিল ফ্রি জাপান ও এলডিসি ওয়াচসহ বিভিন্ন সংগঠন। আয়োজকরা জানান, ৮ দফা এই জনগণের ঘোষণা সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেয়া হবে এবং এটি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।