রেকর্ড পোশাক রফতানি করেও শঙ্কা দেখছেন উদ্যোক্তারা

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক বাণিজ্য এখন দ্রুত বদলাচ্ছে। শুধু সস্তা শ্রম ও উৎপাদন সক্ষমতার ওপর নির্ভর করলে আর চলবে না। বাংলাদেশকে টেকসই উৎপাদন, শ্রম অধিকার নিশ্চিতকরণ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, ডিজাইন ও উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে।

শাহ আলম নুর
Printed Edition
রেকর্ড পোশাক রফতানি করেও শঙ্কা দেখছেন উদ্যোক্তারা
রেকর্ড পোশাক রফতানি করেও শঙ্কা দেখছেন উদ্যোক্তারা

বাংলাদেশের তৈরী পোশাক (আরএমজি) খাত বিগত এক দশকে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে বৈশ্বিক বাজারে অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছে। প্রতিযোগিতামূলক শ্রম ব্যয়, বিশাল উৎপাদন সক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের আস্থার কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গত এক দশকে ধারাবাহিক অগ্রগতি দেখিয়েছে।

তবে খাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারকরা এখন নতুন শঙ্কার কথা বলছেন। তাদের মতে, সামনের দিনগুলো এতটা মসৃণ নাও হতে পারে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন বিধিনিষেধ, বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাক রফতানি হয়েছিল ১১.৫৩ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৪ সালে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ১৮.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা ৫৮.৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে।

একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতেও এসেছে ইতিবাচক সাফল্য। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটেক্সা) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ছিল ৫.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩৫.৮৭ শতাংশে। কেবল ২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারীর কারণে এই ধারা ভেঙেছিল।

২০২২ সালে রফতানির অঙ্ক আরো বড় হয়। সে বছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৯.৭২ বিলিয়ন ডলার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২১.৯২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করা হয়। এতে বোঝা যায়, গত দশকে বাংলাদেশের আরএমজি খাত বৈশ্বিক বাজারে কতটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক শ্রম ব্যয় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল। পাশাপাশি বিশাল উৎপাদন সক্ষমতা, দক্ষ শ্রমশক্তি এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের আস্থা এই সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “গত এক দশকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাক রফতানি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। তবে এই ধারা ধরে রাখা দিন দিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।” হাতেম উল্লেখ করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ (সিএসডিডিডি), ইউরোপীয় গ্রিন ডিল এবং ডিজিটাল প্রোডাক্ট পাসপোর্টের মতো একাধিক বিধান চালু করছে। এগুলো সরবরাহ শৃঙ্খলে স্বচ্ছতা, শ্রম অধিকার রক্ষা ও টেকসই উৎপাদনের ওপর কঠোর নিয়ম আরোপ করবে।

“ইউরোপীয় ক্রেতাদের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে যাতে তাদের সরবরাহকারীরা বাংলাদেশসহ মানবাধিকার, পরিবেশ ও শ্রম মানদণ্ড কঠোরভাবে মেনে চলে। এটি আমাদের শিল্পে সরাসরি ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে,” বলেন তিনি। এ ছাড়া, এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের পর ইইউর জিএসপি প্লাস সুবিধা বজায় রাখতে হলে কঠোর পরিবেশগত ও সামাজিক শাসন সম্পর্কিত শর্ত পূরণ করতে হবে। ব্যর্থ হলে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে, যা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দুর্বল করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীন ও ভারতের পোশাকের ওপর উচ্চ শুল্ক বাংলাদেশকে নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তবে এর ফলে অন্য এক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। মার্কিন বাজারের জন্য উৎপাদন চীন থেকে সরে আসায় চীন ও ভারতীয় প্রস্তুতকারকরা ইউরোপীয় বাজারে প্রবলভাবে প্রবেশ করছে। এতে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “এখন অনেক দেশ সক্রিয়ভাবে ইউরোপীয় বাজার লক্ষ্য করছে। এর ফলে প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে। তাই আমাদের কম খরচে বেশি উৎপাদন নয় বরং উচ্চমূল্য, ডিজাইননির্ভর ও টেকসই উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশকে আর কেবল সস্তা উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে দেখা যাবে না।”

বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মোহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “ভবিষ্যতে পোশাক রফতানি ধরে রাখতে সরকারি নীতি সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। কর ছাড়, সবুজ বিনিয়োগে প্রণোদনা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে শক্তিশালী বাণিজ্য কূটনীতি চালু রাখতে হবে।”

তিনি বলেন, আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। ইউরোপের পরিবর্তনশীল নীতিমালা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিলে চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে রূপান্তর করা সম্ভব। ইইউ বাজারে কোনো বিঘœ ঘটলে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে।

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। তাই একক বাজার নির্ভরশীলতা ঝুঁকি তৈরি করছে। বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, “বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ধরে রাখতে হলে আমাদের উদ্ভাবন, দক্ষতা উন্নয়ন ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারি সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব নয়।”

এ দিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ জানান, নতুন বাজারে প্রবেশ সহজ করতে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে। “আমরা প্রায় ৪৬টি মেলায় অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করছি। এর বেশির ভাগই নতুন বা উদীয়মান বাজারে। পোশাকের পাশাপাশি আরো আটটি সম্ভাবনাময় খাতকে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে,” বলে তিনি জানান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক বাণিজ্য এখন দ্রুত বদলাচ্ছে। শুধু সস্তা শ্রম ও উৎপাদন সক্ষমতার ওপর নির্ভর করলে আর চলবে না। বাংলাদেশকে টেকসই উৎপাদন, শ্রম অধিকার নিশ্চিতকরণ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, ডিজাইন ও উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড কঠোরভাবে অনুসরণ এবং ব্র্যান্ডগুলোর চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। সব মিলিয়ে, বিগত দশকের অর্জন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করালেও সামনে যে চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবেলায় এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি। না হলে রেকর্ড রফতানির পরও শিল্পের অগ্রগতি হোঁচট খেতে পারে।