ঘরের মাঠে রূপকথা ‘জয়ের পরাজয়’

জসিম উদ্দিন রানা
Printed Edition

ওয়ানডেতে জেতার পরও যেন হারটাই বাংলাদেশের নিয়তি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে খানিকটা আনন্দের নিশ্বাস ফেলার পর, চট্টগ্রামের টি-২০ সিরিজে যে চিত্র ফুটে উঠল, তাতে সেই সামান্য আনন্দও গলায় কাঁটার মতো বেঁধে রইল। তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ। নিজেদের ঘরের মাঠে! এটা যেন ‘জয়ের পরাজয়’ নামের এক অদ্ভুত রূপকথা, যার নায়করা মূলত নিজেরাই নিজেদের শত্রু। বোলাররা যথেষ্ট উপকার করেও থাকেন মলিন।

ওয়ানডে সিরিজটা শুরু হয়েছিল আশার আলোয়। প্রথম ম্যাচে ব্যাট-বল দুই বিভাগেই জ্বলে উঠেছিল বাংলাদেশ। মনে হয়েছিল, হয়তো পুরনো সেই ছন্দটা ফিরে এসেছে। কিন্তু পরের ম্যাচেই দেখা গেল সেই চেনা ব্যর্থতা। উইকেট হারানোর আতঙ্ক, ধীরগতির ব্যাটিং, আর রান তাড়ার সময় মানসিক ভাঙন। তবুও সিরিজটা ২-১ এ জিতে কিছুটা মুখ রক্ষা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে সুপার ওভারের হার যেন পুরো সিরিজে এক কালো দাগ টেনে দিলো। রিশাদ হোসেনের আগের ওভারে ঝড় তোলার পরও তাকে সুপার ওভারে না পাঠানো-এ যেন কোচ-অধিনায়কের এক যৌথ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। মাঠে দর্শক হতভম্ব, টেলিভিশনের সামনে বসা ভক্তরা ক্ষুব্ধ। এমন সিদ্ধান্ত কেবল বাংলাদেশের ক্রিকেটেই সম্ভব। যেখানে প্রতিভা নয়, সিনিয়রিটিই সব কিছুর মাপকাঠি।

এরপর এল চট্টগ্রামের টি-২০ সিরিজ। ওয়ানডের সাফল্য ভুলে দলটা যেন ঢুকে পড়ল নিস্তেজতার অন্ধকারে। তিন ম্যাচ, তিন হারে শেষ। প্রতিটি ম্যাচেই এক রকম গল্প, উইকেট পড়ছে নিয়মিত, কেউ দাঁড়িয়ে লড়াই করছে না। পাওয়ার হিটিং বলতে কিছু নেই, ফিল্ডিংয়ে শিশুসুলভ ভুল, আর অধিনায়কের কৌশল দেখে মনে হয়, ক্রিকেটটা যেন পরীক্ষার আগের রাতেই পড়া শুরু করেছেন। বিপরীতে ওয়েস্ট ইন্ডিজদের চোখে তখন উজ্জ্বল আত্মবিশ্বাস, বাংলাদেশের চোখে ভয়-বিভ্রান্তি।

সিরিজ শেষে স্কোরকার্ডে ফলাফল শুধু পরিসংখ্যান নয়। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের অসুস্থ মানসিকতার প্রতিফলন। ওয়ানডেতে জিতেও আত্মতুষ্টি, টি-২০তে হেরে লজ্জাসব মিলিয়ে এক মিশ্র নাটক। প্রশ্ন উঠছে, কোথায় সেই প্রতিশ্রুতির দল, যারা একসময় বড় দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ করত? এখন তো দেখা যাচ্ছে, প্রতিপক্ষ একটু চাপ দিলেই ভেঙে পড়ে গোটা ব্যাটিং অর্ডার। দলীয় পরিকল্পনা বলে কিছু থাকে না, কৌশল মানেই যেন ‘যা হয় হবে’ নীতি।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, এই ব্যর্থতার মধ্যে কোনো তাড়না দেখা যায় না। কোচরা ম্যাচ শেষে বলেন, ‘শিখছি’, ‘সময় লাগবে’, ‘এই হার থেকে শিক্ষা’ বুলিগুলো এখন বিরক্তিকরভাবে চেনা। আর বোর্ডের কর্মকর্তারা? তারা ব্যস্ত পরবর্তী ট্যুরের স্পন্সর ঘোষণায়। ক্রিকেটাররা মাঠে খেলে না, খেলে কেবল নামের ভারে।

‘টাইগার’ শব্দটা এখন কানে বাজে, কারণ মাঠে তাদের দেখা যায় বিড়ালের মতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই সিরিজটা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের আয়না। সেখানে ফুটে উঠেছে দলগত দুর্বলতা, মানসিক দুর্বলতা, আর নেতৃত্বের শূন্যতা। ওয়ানডেতে সামান্য হাসি এনে যে দল টি-২০তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে, সেই দলের ভবিষ্যৎ নিয়েই এখন চিন্তা করার সময়। কারণ ক্রিকেট কেবল প্রতিভা নয়-চাই সাহস, পরিকল্পনা আর সঠিক সিদ্ধান্ত। এক কথায়, এই সিরিজ প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশ এখনো শিক্ষক ছাড়া শেখার ক্লাসেই আছে।