অন্যায় অনিয়মের অভিযোগ বা প্রতিবাদ করলেই বদলি এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে অগ্রণী ব্যাংকে। ইতোমধ্যেই বানোয়াট অভিযোগ তুলে বদলি করা হয়েছে ভোলা জোনের আওতাধীন ভোলা শাখার ম্যানেজার এজিএম আলমগীর হোসেনকে, অথচ তিনি কাজ করছিলেন ব্যাংকের স্বার্থে।
ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পাওয়ার পর সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও ঋণ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো: জিয়াউদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে এখন নিজেই পেয়েছেন বদলির নোটিশ। তাকে চলে যেতে হয়েছে চট্টগ্রাম সার্কেলে। এসবের নেপথ্যে কাজ করেছে এই ব্যাংকের বরিশাল সার্কেল ও ভোলা জোনের একটি দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও সে অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো ‘গণমাধ্যমে তথ্য প্রদানকারী’ সন্দেহে সৎ ও ব্যাংকের জন্য নিবেদিত অফিসারদের জোন ও সার্কেলের বাইরে বদলি করে দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টদের আগলে রাখছেন বরিশাল সার্কেলের জিএম জাহিদ ইকবাল এবং ভোলা জোনের ইনচার্জ গণেশ চন্দ্র দেবনাথ।
অনেক ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনার অনুসন্ধান করে জানা গেছে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি এজিএম আলমগীর হোসেন ভোলা শাখার ঋণ বিভাগের প্রধান সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার জিয়াউদ্দিনের ঋণ বিতরণে বেশ কিছু অনিয়মের প্রমাণ তুলে ধরে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেন। যেখানে টি২৪ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ১২ লাখ টাকা ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে জিয়াউদ্দিন ইন্টারেস্ট রেট শূণ্য দেখিয়েছেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে নানা জালিয়াতি ও ঋণ আদায়ে গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে তাকে সতর্ক করা হলে ক্ষুব্ধ হয় জিয়াউদ্দিন ও তার অপকর্মের দোসর ভোলা জোনাল অফিসের কিছু কর্মকর্তা।
এদিকে মেসার্স আরোহী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাশেমকে ৫০ লাখ টাকার ঋণের নবায়ন আবেদন যাচাই করে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি এজিএম আলমগীর হোসেন। ফলে তিনি সেটি নবায়ন না করায় জিয়াউদ্দিন সিন্ডিকেটের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। কেননা এখানে ছিল বড় অঙ্কের লেনদেন। যার ভাগবাটোয়ারার বড় অংশ পেতেন জোনাল অফিস।
অনুসন্ধানের দেখা গেছে, আরোহী ট্রেডার্স হিসাব নং ০২০০০১৯৩৭৪০৯৩ সিসি ৩ নভেম্বর ২০১২ সালে অগ্রণী ব্যাংক ভোলা শাখা থেকে ঋণ গ্রহণ করার পর কোনোরকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াই প্রতি বছর ঋণ নবায়ন করে আসছে। এজিএম আলমগীর হোসেন সরেজমিনে তদন্তের মাধ্যমে ‘আরোহী ট্রেডার্স’ নামে বাস্তবে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান না থাকার প্রমাণ পান এবং এটির নবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। এতে জোনাল প্রধানসহ সার্কেল অফিসের একাধিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বাড়তি উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়।
তারা (সিন্ডিকেট) আরোহী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাশেমের ছেলে মিজানুর রহমান জিতুর মাধ্যমে এজিএম আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ দায়ের করান। তারা মাঠপর্যায়ে সঠিক তদন্ত না করে এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে এজিএম আলমগীর হোসেনকে কাগজে-কলমে অভিযুক্ত করেন। ব্যাংকের স্বার্থে কাজ করে আলমগীর হোসেন হয়ে গেলেন ‘কাল্পনিক অভিযুক্ত’ আর ‘প্রকৃত অভিযুক্ত’ জিয়াউদ্দিন ঋণ প্রদান কর্মকর্তা থেকে প্রমোশন নিয়ে একই শাখার ম্যানেজারের দায়িত্ব পেলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানালেন, এই ব্যাংকের কয়েকটি ঘটনায় দেখেছি- ‘এখানে চোরের কোনো শাস্তি হয় না, যারা চোর ধরিয়ে দেয় তাদের শাস্তি হয়’।
অন্য দিকে এই জিয়াউদ্দিন ইতোপূর্বে চরফ্যাশন শাখায় ম্যানেজার থাকাকালে ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণের পরও যথাসময়ে ঋণখেলাপি না করা, খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত দেখিয়ে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৫৫ টাকা সুদ চার্জ করা এবং তিন লাখ ৩৫ হাজার ৯১৯ টাকা ইনস্যুরেন্স কর্তন করার অভিযোগে মহাব্যবস্থাপকের সচিবালয়, বরিশাল সার্কেল কর্তৃক গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ব্যাখ্যা তলব করা হয়। ঐ সময় জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ভিজিলেন্স ডিভিশনের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও ভোলা জোনাল অফিসের প্রধান গণেশ চন্দ্র দেবনাথ এবং ভোলা শাখা ব্যবস্থাপক (বর্তমানে বরিশাল সার্কেল অফিসে কর্মরত) পংকজ কুমার নাথসহ বরিশাল সার্কেল অফিসের কয়েকজন যৌথভাবে অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে ঐ সময় জিয়াউদ্দিনকে রক্ষা করেন বলে জানা গেছে।
ঐ সময় ভুয়া নমিনী সাজিয়ে মৃত অলিয়ার রহমানের হিসাব নং- ০২০০০০৩৫৯৭৭৭৩ থেকে ৭,৫০,৭৫২ টাকা আত্মসাৎ করেন জিয়াউদ্দিন। যা থেকে পংকজ কুমার নাথ মো: জিয়াউদ্দিন এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ওপর দায়সারা তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে অব্যাহতি দেন। এ ছাড়াও চরফ্যাশন শাখার মেসার্স বিকাশ স্টোরের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকে দায়ের করা সিআর মামলাটি (নং ৪২৫/১৬) তৎকালীন ম্যানেজার জিয়াউদ্দিনের অবহেলায় খারিজ হয়ে যায়। সেজন্য তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অগ্রণী ব্যাংকের হেড অফিসের ২১/০৪/২৪ খ্রি: তারিখের পত্রে মো: জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও ভোলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিজিএম গণেশ চন্দ্র দেবনাথ কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আলমগীর হোসেনকে সরিয়ে তাকেই ভোলা শাখার ম্যানেজার হিসাবে সুপারিশ করেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়াও জিয়াউদ্দিনের আরো অসংখ্য অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে। সে কোনো ধরনের ঋণ গ্রহণ ব্যতিরেকে ভোলা শহরের সার্কুলার রোডে ৬ (ছয়) শতাংশ জমি কেনেন ৯০ লাখ টাকা দিয়ে, এ ছাড়াও ভোলা শহরের যুগীরঘোলে মুন্সীবাড়ির ভেতর ৩ শতাংশ জমি কিনেছেন ২১ লাখ টাকা দিয়ে। অথচ তিনি চাকরিতে জয়েন করেন ০১/০৩/২০১৩ সালে। তার বেতনের সমুদয় টাকা দিয়েও এই জমি কেনা সম্ভব নয় বলে মনে করেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। তার আয় ও সম্পদের বিবরণী বিশ্লেষণ করলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
সব মিলিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বরিশাল সার্কেল অগ্রণী ব্যাংক। প্রতিটি শাখা নিয়ন্ত্রণ করছেন বরিশাল সার্কেলের ভেতর দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজ সিণ্ডিকেট। এরা কৌশলে সৎ কর্মকর্তাদের বদলি করে দিয়ে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করছে অগ্রণী ব্যাংক বরিশাল সার্কেলের প্রতিটি শাখায়।
এসব বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংক ভোলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিজিএম গণেশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, হেড অফিসের নিয়ম অনুযায়ী সব বদলি ও প্রমোশন হয়েছে। এখানে আমার কিছু করার নেই। ভোলা জোনের কোনো অভিযোগ বিষয়ে জানতে হলে ফোনে নয়, মুখোমুখি আসুন, বক্তব্য নিন।



