সাত কলেজের সৃষ্ট সমস্যায় রাজপথে সীমাহীন ভোগান্তি

একাধিক পক্ষ অনড় থাকায় সমস্যার সমাধান হচ্ছে না

চব্বিশের ৫ আগস্টের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাত কলেজ নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করা হলেও এখানে নানা পক্ষ জড়িত থাকায় সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং আরো ঘনীভূত হয়েছে। এখন শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা রাজপথে প্রায়ই চলে আসছে। আর এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরের লাখো বাসিন্দাকে। গত এক মাসের ব্যবধানে এই একই ইস্যুতে নীলক্ষেত, সিটি কলেজ মোড় কিংবা সাইন্সল্যাররেটরি মোড় এমনকি সর্বশেষ ব্যস্ততম এলাকা রাজধানীর শাহবাগ মোড়েও একাধিক দিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

দীর্ঘ এক দশকেও রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজ নিয়ে তৈরি সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ২০১৭ সাল থেকে এই কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও বিভিন্ন পক্ষ থেকে সমস্যা জিয়াইয়ে রাখার ইন্ধন দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাত কলেজ নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করা হলেও এখানে নানা পক্ষ জড়িত থাকায় সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং আরো ঘনীভূত হয়েছে। এখন শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা রাজপথে প্রায়ই চলে আসছে। আর এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরের লাখো বাসিন্দাকে। গত এক মাসের ব্যবধানে এই একই ইস্যুতে নীলক্ষেত, সিটি কলেজ মোড় কিংবা সাইন্সল্যাররেটরি মোড় এমনকি সর্বশেষ ব্যস্ততম এলাকা রাজধানীর শাহবাগ মোড়েও একাধিক দিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে।

এ দিকে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ চাইছে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী চলতি শিক্ষাবর্ষ (২০২৪-২৫) থেকেই ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা হোক। আবার শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই কলেজগুলোর স্বতন্ত্রতা রক্ষা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সত্তা বিনষ্ট করে একত্রীকরণ বন্ধ করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজ একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে জোর আপত্তি জানিয়েছেন বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী অবসরপ্রাপ্ত ২৫ ক্যাডার সমন্বয় পরিষদ’। ঢাকার এই সাতটি সরকারি কলেজের জন্য যে প্রক্রিয়ায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি বলেও জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন এই সাত কলেজের জন্য একটি অধিভুক্তমূলক বিশ্ববিদ্যালয় (অনেকটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো) করে বিরাজমান সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের আলোকে এবং অংশীজনদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলেও মনে করেন পরিষদের নেতারা। সম্প্রতি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এসব দাবির বিষয়ে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী অবসরপ্রাপ্ত ২৫ ক্যাডার সমন্বয় পরিষদের নেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে সাত কলেজের সমস্যা ছাড়াও ২৫ ক্যাডারের বৈষম্যের শিকার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও সুবিধা দেয়া, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে সংগঠনটি। পরিষদের সমন্বয়ক আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল জানিয়েছেন ঢাকা মহানগরীর ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজ নিয়ে শিক্ষা খাতে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। মূল অংশীজনদের এড়িয়ে গিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করায় সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। কেউ স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কেউ বিপক্ষে। এ ছাড়া একটি মহল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘লোভ দেখিয়ে’ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বলেও শোনা যায়, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির (বর্তমান নাম বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন) সাবেক সভাপতি আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার মনে করেন সাত কলেজের জন্য একটি অ্যাফিলিয়েটিং (অধিভুক্তমূলক) ইউনিভার্সিটি হোক এবং কলেজগুলোর আর্থিক স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা দিলে শিক্ষার মান অবশ্যই বাড়বে। এ ক্ষেত্রে এই কলেজগুলোতে মেধাবী শিক্ষকদের পদায়নের ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

অপর দিকে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা অতি দ্রুত ক্লাস শুরুর দাবিতে গতকাল রোববারও রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছেন। এর আগে দুুপুর থেকে ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন তারা। সেখানে অবস্থান কর্মসূচি শেষ করে আড়াইটার দিকে শাহবাগের দিকে আসেন। এ সময় শাহবাগ মোড়ে অবস্থান করে তাদেরকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ক্লাস শুরু হচ্ছে না। অতি শিগগিরই ক্লাস শুরু করতে হবে। তা না হলে রাজপথে আন্দোলন করে দাবি আদায় করা হবে। যদিও বেশ কিছু দিন আগেই (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং) ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির (প্রস্তাবিত) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ক্লাস শুরুর তারিখ ঘোষণা করা হয়। একই সাথে সাবজেক্ট ও কলেজ চয়েজের ফল প্রকাশ করা হয়। সেদিন প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নির্বাচিত শিক্ষার্থীদেরকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বলা হয় এবং ভর্তি শেষে ৩০ অক্টোবর থেকে ক্লাস শুরুর কথা জানানো হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ও বড় সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পর থেকেই এটি দেশের শিক্ষাঙ্গনে শত সমস্যার একটি বড় সমস্যা হিসেবে যুক্ত হয়। এটি আরেক ধাপ এগিয়ে বলা চলে রাজধানীর নাগরিক জীবনে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত তিন-চার বছরে এ কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা যে কতবার সড়ক অবরোধ করেছে তার হিসাব নেই। দাবি কিছু একটা করতে হলেই তারা অবরোধ করেন নীলক্ষেত কিংবা সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়। নিজ নিজ ক্যাম্পাসের সামনেও বিভিন্ন সময়ে কর্মসূচি পালন করেছেন সাত কলেজ নামে পরিচিতি পাওয়া ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বাঙলা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এ কলেজগুলো দেশের, বিশেষ করে রাজধানীর শিক্ষাক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে সময় কলেজগুলো নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনা ছিল না। কিন্তু ২০১৭ সালে বৃহৎ এ সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলো। এর পেছনে কিছু মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। এর মধ্যে রয়েছে এ কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠক্রম, পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ মানের করা।

সূত্র জানায় এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় লাখের বেশি, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত শিক্ষার্থীর প্রায় চারগুণ বেশি। এ সাতটি কলেজের অন্তত তিনটি কলেজ ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ ও ইডেন কলেজ অবকাঠামোগত দিক, শিক্ষক আর শিক্ষার্থী বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার মতো। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজারের মতো। দেশের বেশির ভাগ বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালেয়র শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর চেয়ে কম। দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ১২ হাজারের মতো। সাত কলেজের কোনোটির শিক্ষার্থীর সংখ্যাই এর চেয়ে কম নয়।

তবে সঙ্কট সমাধানে অবশ্য এবার সরকার কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি কমিটিও গঠন হয়েছে। এ সমস্যাটির একটি সুন্দর সমাধান অবশ্যই বের করতে হবে। সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেখে করলে এর সমাধান দ্রুত হতে পারে। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, সাত কলেজের ব্যাপারে সরকারকে ইতিবাচক মন আর মানসিকতা নিয়ে সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেখে হোক কিংবা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই হোক এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। উপরিউক্ত দু’টি ধারণার যেকোনোটির মাধ্যমেই হোক সমস্যার সমাধান হলে তা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে তৈরি করবে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য, প্রসারিত করবে দক্ষ জনবল গড়ার ক্ষেত্র।