চবির সবুজ ক্যাম্পাসে কুপিয়ে খুন করা হয় শিবির নেতা মুজাহিদ ও মাসুদকে

ফ্যাসিবাদ আমলের গুম-খুন-হয়রানি

নূরুল মোস্তফা কাজী, চট্টগ্রাম ব্যুরো
Printed Edition

ফ্যাসিবাদী আমলে আধিপত্য বিস্তারের নেশায় মৃত্যু উপত্যকায় রূপ নেয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড চালায় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা চাপাতি আর রামদা দিয়ে কোপাতে কোপাতেই খুন করে শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম ও মাসুদ বিন হাবিবকে। ২০১২ সাালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে এই জোড়া খুনের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রলীগ ক্যাডার পীযূষ কান্তি বর্মণ, কাজী তানজিম হোসেন, আহসানুল করিম জনি, আশরাফুল ইসলাম আশা, আবুল মনসুর সিকদার, সুমন, মামুনরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে নিহতদের সতীর্থদের দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরোপয়েন্টের সামনে নজিরবিহীন নৃশংসতায় জোড়া খুনের এই ঘটনায় তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। খুনিদের বিচারের জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে ইতোমধ্যে মারা গেছেন মাসুদের পিতা। মাসুদের মা বেঁচে থাকলেও অসুস্থ। আর মুজাহিদের পিতা-মাতা দু’জনেই এখন শয্যাশায়ী। আলোচিত এই জোড়া খুনের তদন্তের পুরো প্রক্রিয়াটাই প্রশ্নবিদ্ধ নিহতদের পরিবারের কাছে। তাই তারা চব্বিশের পট পরিবর্তনের পর প্রকৃত খুনিরা কাঠগড়ায় দাঁড়াবে এমন প্রতীক্ষায় আছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় সেদিনের কিলিং মিশন : ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২। অন্যান্য দিনের ন্যায় শাটল ট্রেনে চেপে আসা শিক্ষার্থীতে ঠাসা চবি ক্যাম্পাস। যথাসময়ে ক্লাস শুরু হয়েছে প্রতিটি অনুষদে।

সকাল ১০টা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শিবিরকর্মী ফিরোজ হাসনাত ও আল আমিনের সাথে বাগি¦তণ্ডায় লিপ্ত হয় তাদেরই সহপাঠী ছাত্রলীগ কর্মী শাহীন। বিতণ্ডার কারণ ছিল, তাদের অন্য এক সহপাঠী নাজমুল ফরায়েজীকে নিয়মিত ক্লাসে ভালো রেসপন্স করার কারণে মারধর ও ক্লাসে আসা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মী শাহীন। আর সেই অপরাধে ক্লাস শেষ হলেই শিবির কর্মীদের ওপর আক্রমণের জন্য জড়ো হতে থাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সম্ভাব্য আক্রমণের খবর জেনে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন শিবিরের কলা অনুষদ শাখার সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, চেষ্টা করেন সমঝোতার। কিন্তু মুহূর্তেই প্রায় ৪০ জন সশস্ত্র ছাত্রলীগ নেতাকর্মী একত্র হয় কলা অনুষদের ঘটনাস্থলে। কথাবার্তার ফাঁকেই ছুরিকাঘাত করে আহত করে আবদুল্লাহ নাঈম নামের এক শিবির নেতাকে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত করা হয় কলা অনুষদ শাখার সভাপতি আবুল কালাম আজাদকে। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চলতে থাকলেও তৎকালীন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সাহসী ভূমিকার কারণে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। ইত্যবসরে ছাত্রলীগ কর্মীরা বহিরাগতসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেট গোলচত্বরের দিকেও জড়ো হতে থাকে। প্রশাসনের সবুজ সঙ্কেত পেলেই শাহ আমানত হল দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিভলবার, রামদা আর চাপাতি নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। কিন্তু ছাত্রশিবিরের প্রতিরোধে তারা কয়েক দফায় পিছু হটে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ও পুলিশের ভূমিকা ছিল একেবারে একপেশে। এমনি পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের নীরব দর্শকের ভূমিকায় আরো বেপরোয়া হতে থাকে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা।

তখনকার শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শাহ আমানত হল দখলে ব্যর্থ হয়ে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২নং গেট দিয়ে প্রবেশ করানো হয় বিপুল পরিমাণ পুলিশ। তারা অবস্থান নেয় শিবির কর্মীদের ঠিক পেছনে। শিবিরকর্মীদের সামনে ছাত্রলীগ আর পেছনে পুলিশ। আর দেরি নয়, আকস্মিকভাবে পেছন থেকে শিবির কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে মোতায়েনকৃত পুলিশ বাহিনী। অপর প্রান্ত থেকে অস্ত্র, রামদা ও চাপাতি দিয়ে আক্রমণ শুরু করে ছাত্রলীগ। এ সময় তারা মুজাহিদুল ইসলামকে ধরে চাপাতি ও রামদা দিয়ে মাথা ও সমস্ত দেহে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। মুজাহিদের ওপর এই অতর্কিত আক্রমণ দেখে থমকে দাঁড়ান মাসুদ বিন হাবিব। রক্তপিপাসুদের জিঘাংসার হাত থেকে মুজাহিদকে উদ্ধার করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় নামেন। কিন্তু তা হয়নি বরং পিশাচরা মুজাহিদের মতো একইভাবে চাপাতি ও রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে মাসুদের মাথা ও সমস্ত শরীর জুড়ে। রক্তাক্ত মুজাহিদ ও মাসুদ লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। শত শত পুলিশের সামনেই এমন পাশবিক ঘটনা ঘটলেও পিচাসরা কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি সেদিন।

এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী মাসুদ ও মুজাহিদকে যাতে হাসপাতালে নিতে না পারে সেজন্য তখনকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ইশারায় সব অ্যাম্বুলেন্সকে ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। একটি পরিত্যক্ত রিকশাভ্যানে করে আহতদের পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার থেকে সিএনজিতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন।

চবি শিবিরের সাবেক সভাপতি রাজিফুল হাসান বাপ্পি নয়া দিগন্তকে বলেন, এমন নির্মমতা চবি ক্যাম্পাসে বিরল। প্রিয় দুই সহযোদ্ধাকে হারিয়ে শিবিরের নেতাকর্মীরা যখন শোকে মুহ্যমান তখনই পুলিশ ছলচাতুরির মাধ্যমে আমানত হল গেট থেকে উল্টো গ্রেফতার করে বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের ১১জন নেতা কর্মীকে। এ যেন জুলুম আর নিষ্ঠুরতার এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। এ দিকে দুইজন ছাত্রের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পুরো চট্টগ্রাম শহরজুড়ে। প্রতিবাদ থামানোর উপায় হিসেবে এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। খালি করা হয় সব হল। জানাজা নামাজ পড়তে বাধা শুধু চট্টগ্রামে নয়, দুই শহীদের বাড়ির পথেও পুলিশী প্রহরা বসানো হয়। দূর-দূরান্ত থেকে শহীদদের শেষ বিদায় জানাতে আসা আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহপাঠী কেউই রেহাই পায়নি পুলিশের হয়রানি থেকে।

নিহত মুজাহিদের ছোট ভাই প্রকৌশলী মীর মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, বাবা-মা বেঁচে থাকলেও অসুস্থতায় দিন যাপন করছেন। ফ্যাসিবাদী আমলে এক ধরনের ফ্রেমবন্দী তদন্ত হয়েছে, তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রকৃত অপরাধীরা যাতে শাস্তির মুখোমুখি হয় সেজন্য নতুন করে তদন্ত হওয়া উচিত। এটা তদন্তাধীন বিষয় হিসেবে আমরা নতুন করে তদন্ত চাই। আমরা পারিবারিকভাবে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে আলাপ আলোচনা করছি। আব্বু আম্মু দুইজনই যেমনি অসুস্থ, সরকারও আরো স্থিতিশীল হওয়া প্রয়োজন। সেজন্য আমরা কিছুটা সময় নিচ্ছি। আমার ভাই প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তিনি তো আর সন্ত্রাসী ছিলেন না, তাই আমরা সরকারের কাছে আর কী চাইতে পারি সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ভাইয়ের হত্যার সত্যিকার একটি বিচার চাই, প্রকৃত কিলাররা যাতে শাস্তি পায়।

নিহত মাসুদ বিন হাবিবের বড় ভাই খালেদ ইবনে হাবিব নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা ৫ ভাই ২ বোন। সে ছিল ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। নতুন মামলার জন্য নথিপত্র জোগাড় করা হচ্ছে। যারা অপরাধী, খুনি ওদের শাস্তিই আমাদের চাওয়া। ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে আদরের মাসুদকে হারিয়ে আমার আব্বু খুনিদের বিচারের জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে শেষ পর্যন্ত তিন বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। প্রকৃত খুনিদের বিচারের জন্য আমরা নতুন করে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।