ঘাতকের দুই সহযোগীও লাপাত্তা

শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঘাতক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুলের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রুবেল ও মাইনুদ্দীনের কোনো সন্ধান পাচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তারা আত্মগোপনে রয়েছে।

Printed Edition

জিলানী মিলটন ও এস এম মিন্টু

  • ফয়সালের অ্যাকাউন্টে ১২৭ কোটি টাকার লেনদেন
  • হাদির ঘাতক বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য নেই : অতিরিক্ত আইজিপি
  • হালুয়াঘাটে নিয়ে যাওয়া দুই প্রাইভেট কারের চালক নজরদারিতে
  • পালাতে সহায়তাকারী দুইজন ফের রিমান্ডে
  • মোটরসাইকেল চালক হান্নানের জামিন

জুলাইযোদ্ধা, ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্রপ্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঘাতক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুলের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রুবেল ও মাইনুদ্দীনের কোনো সন্ধান পাচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তারা আত্মগোপনে রয়েছে।

এ দিকে ঘাতক ফয়সাল করিম ও তার সহযোগী আলমগীরকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে নিয়ে যাওয়া দুই প্রাইভেট কারের চালক সাদ্দাম ও সুমনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

অপর দিকে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, শরিফ ওসমান হাদির ঘাতক ফয়সালের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে তাকে গ্রেফতারে দেশজুড়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

হত্যার আগের ও পরের গতিবিধি : একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গত ১২ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে গুলি করার আগের দিন বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম ও যুবলীগ নেতা আলমগীর নরসিংদী থেকে ঢাকার আগারগাঁওয়ে ফয়সালের বোনের বাসায় ওঠেন। সেখানে নাশতা করার পর রাত ১১টার দিকে তারা মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন। এরপর তারা বন্ধু রুবেলের কেরানীগঞ্জের বাসায় গিয়ে আড্ডা দেন এবং রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। পরে আড়াইটার দিকে ফয়সাল তার বান্ধবীকে নিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের একটি রিসোর্টে যান। সকাল ৮টার দিকে তারা সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। ঢাকায় ঢুকে বান্ধবীকে নামিয়ে দিয়ে পুনরায় আগারগাঁওয়ের বোনের বাসায় ওঠেন।

সেখানে রাখা একটি ব্যাগ থেকে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বেলা ১১টার পর ফয়সাল করিম ও আলমগীর মতিঝিলে ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। জুমার নামাজ শেষে ওসমান হাদি একটি অটোরিকশায় বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে এলে পেছন থেকে মোটরসাইকেলে কাছাকাছি পৌঁছে ফয়সাল ও আলমগীর তাকে গুলি করেন।

ঘটনার পর থেকেই ফয়সাল করিম, আলমগীর এবং তাদের দুই সহযোগী রুবেল ও মাইনুদ্দীন আত্মগোপনে চলে যায়।

হালুয়াঘাট হয়ে সীমান্তমুখী চেষ্টা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কিলিং মিশনের পর ১২ ডিসেম্বর ফয়সাল করিম ও আলমগীর দুইটি প্রাইভেট কারের সাহায্যে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে যান। চালকেরা তাদের আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া নেয়। পরে ময়মনসিংহের একটি স্থানে গিয়ে তারা মোবাইল ফোন ফেলে দেন এবং মানবপাচারকারী ফিলিপের সাথে অন্য একটি নম্বরে যোগাযোগ করেন।

ফিলিপ তাদের হালুয়াঘাটের মুন ফিলিং স্টেশনের সামনে আসতে বলেন। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে ফিলিপের দুই সহযোগীর সহায়তায় তাদের সীমান্ত এলাকার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আসামিদের পালাতে সহায়তার অভিযোগে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত জোরদার করা হয়েছে।

“ফয়সালের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য নেই”: অতিরিক্ত আইজিপি

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত আইজি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত এ ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ফয়সাল ও আলমগীর দেশের ভেতরে রয়েছে কি না তা জানতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। একই সাথে হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড কে, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ালে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি সতর্ক করেন।

ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান শফিকুল ইসলাম, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এস এন মো: নজরুল ইসলাম, বিজিবির ময়মনসিংহ সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান এবং র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী।

ডিবি প্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে। ব্যক্তিগত শত্রুতার আলামত পাওয়া যায়নি। হত্যায় ব্যবহৃত শর্টগান, পিস্তল, গোলাবারুদ ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে।

বিজিবি সেক্টর কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ময়মনসিংহসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং মানবপাচারকারী ফিলিপকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

ফের রিমান্ডে সিবিউন-সঞ্জয় : ওসমান হাদি হত্যা মামলায় প্রধান অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদকে ভারতে পালাতে সহায়তার অভিযোগে গ্রেফতার সিবিউন দিউ ও সঞ্জয় চিসিমকে দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।

গতকাল রোববার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো: সেফাতুল্লাহ শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর তাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছিল।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আবেদনে বলা হয়, সীমান্ত পারাপারকারী চক্রের হোতা ফিলিপকে শনাক্ত ও গ্রেফতারের জন্য ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।

মোটরসাইকেল মালিক হান্নানের জামিন

হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক সন্দেহে গ্রেফতার আব্দুল হান্নান জামিন পেয়েছেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো: হাসান শাহাদাত শুনানি শেষে তার জামিন মঞ্জুর করেন।

র‌্যাব-২ গত ১৩ ডিসেম্বর তাকে আটক করে পল্টন মডেল থানায় সোপর্দ করে। রিমান্ডে তাকে শোরুম মালিকের মুখোমুখি করা হয়। তবে তার মোটরসাইকেল ছিল সুজুকি জিক্সার, আর হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ছিল হোন্ডা হর্নেট মডেলের।

ফয়সালের অ্যাকাউন্টে ১২৭ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন

সিআইডি জানিয়েছে, ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে ১২৭ কোটি টাকার বেশি অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আবু তালেব জানান, এই লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী অনুসন্ধানাধীন। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সিআইডি আরো জানায়, হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সক্রিয় ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে একাধিক টিম কাজ করছে। মূল অভিযুক্ত ও পুরো অপরাধী চক্রকে গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

হাদি হত্যা : মামলায় দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা সংযোজনের আদেশ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলাটিতে দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা (হত্যা) সংযোজনের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্দিক আজাদ এ আদেশ দেন।

গতকাল রোববার পল্টন থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক রোকনুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে শনিবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ মামলাটিতে ৩০২ ধারা সংযোজন করার জন্য ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করেন।

আবেদনে উল্লেখ করা হয়, শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলার এজাহারনামীয় পলাতক আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুল দাউদ (৩৭) ও অজ্ঞাতনামা সহযোগী আসামিরা গত ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করা, জনমনে আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি করা, সর্বোপরি আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৬ কে বাধা প্রদান এবং আগ্রহী প্রার্থীদের মনোবলে আঘাত হানার মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এরই অংশ হিসেবে মতিঝিল মসজিদ (ওয়াপদা মসজিদ) হতে জুমার নামাজ শেষে নির্বাচনী প্রচারণা সমাপ্ত করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার পথে গত ১২ ডিসেম্বর অনুমানিক বেলা ২টা ২০ মিনিটের দিকে শরিফ ওসমান হাদিকে বহনকারী অটোরিকশা পল্টন মডেল থানাধীন বক্স কালভার্ট রোডস্থ ডিআর টাওয়ারের সামনে বিজয়নগর পানির ট্যাংকের অভিমুখী পাকা রাস্তার উপর পৌঁছালে তার (শরিফ ওসমান হাদি) পেছন হতে অনুসরণ করে আসা মোটরসাইকেলে থাকা আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুল দাউদ ও তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামি শরিফ ওসমান হাদিকে চলন্ত অবস্থায় হত্যার উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা গুলি করে পালিয়ে যায়।

এতে আরো বলা হয়, শরিফ ওসমান হাদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। তার অবস্থা আরো আশঙ্কাজনক হলে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে হাদির শারীরিক অবস্থা আরো আশঙ্কাজনক হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। ১৮ ডিসেম্বর তিনি সিঙ্গাপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯ ডিসেম্বর শরিফ ওসমান হাদির লাশ বাংলাদেশে আনা হয়। মামলাটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনা। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে মামলায় দায়েরকৃত ধারার সাথে ৩০২ পেনাল কোড ধারা সংযোজনের আদেশদান প্রয়োজন।