একই দিনে দুই পুঁজিবাজারে সূচকের ভিন্ন আচরণ

লোকসান সাড়ে ১২টাকা; দাম বাড়ল ২৩ শতাংশ

Printed Edition

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

স্বাভাবিক আচরণ করছে না দেশের পুঁজিবাজার। একই দিন দেশের দুই পুঁজিবাজারে দেখা মিলছে ভিন্ন আচরণের। যেখানে উভয় পুঁজিবাজারেই তালিকাভুক্ত ও লেনদেন হচ্ছে একই সিকিউরিটিজের সেখানে দুই বাজারের দুই ধরনের আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে বিনিয়োগকারীদের কাছে। গতকাল দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ছিল সূচকের মিশ্র আচরণ। অপর দিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সব সূচকেরই বড় ধরনের পতন ঘটতে দেখা যায়। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এ মুহূর্তে আমাদের পুঁজিবাজার কোনো সূত্র মানছে না। অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য এটা কোনোভাবেই একটি ভালো লক্ষণ বলা যায় না।

নানামুখী সংস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো ভালো ফল দেখা যাচ্ছে না দেশের পুঁজিবাজারে। দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে থাকা পুঁজিবাজারগুলো রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে এমনটিই প্রত্যাশা ছিল বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু ক’দিন পরই তাদের সে প্রত্যাশায় গুড়ে বালি। বিগত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা পতনের মুখে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজারগুলো। গতকাল নিয়ে এ সপ্তাহের তিনটি কর্মদিবসেই কমবেশি সূচক হারিয়েছে বাজারগুলো। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই ঘটে চলেছে এ পতন। চলমান এ পতনের পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাবকে দায়ী করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অংশীজনদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বাজার তথা বিনিয়োগকারীদের মাঝে একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে চাইলেও তা কাজ করছে না। প্রতিদিনই যথারীতি পতনের শিকার হচ্ছে পুঁজিবাজারগুলো।

গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকের মিশ্র আচরণ দেখা যায়। এর আগে দু’দিন টানা পতন ঘটলেও গতকাল দিনের শুরুতে ঊর্ধ্বমুখী ছিল বাজারটি। ৫ হাজর ৮৬ দশমিক ৮৫ পয়েন্ট থেকে সকালে লেনদেন শুরু করা সূচকটি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পৌঁছে যায় ৫ হাজার ১২১ পয়েন্টে। এ পর্যায়ে সূচকের উন্নতি রেকর্ড করা হয় প্রায় ৩৫ পয়েন্ট। সূচকের এ অবস্থান থেকেই শুরু হয় বিক্রয়চাপ। দিনের বাকি সময় এ চাপ অব্যাহত থাকলে বৃদ্ধি পাওয়া সূচকের পুরোটাই হারিয়ে বসে বাজার। দিনশেষে ২ দশমিক ৭২ পয়েন্ট হারিয়ে ৫ হাজার ৮৪ দশমিক ১২ পয়েন্টে স্থির হয় সূচকটি। ডিএসইর দুই বিশেষায়িত সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ ৪ দশমিক ৩৫ পয়েন্ট উন্নতি ধরে রাখলেও ১ দশমিক ৫৪ পয়েন্ট অবনতি ঘটে শরিয়াহ সূচকের। অপর দিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক সিএএসপিআই গতকাল ৮৫ দশমিক ০৫ পয়েন্ট হারায়। এখানে দুই বিশেষায়িত সূচক সিএসই-৩০ ও সিএসই শরিয়াহ হারায় যথাক্রমে ১২২ দশমিক ২০ ও ৪৯ দশমিক ২২ পয়েন্ট।

এ দিকে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশের আচরণ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়ে বাজারগুলোতে স্বাভাবিক আচরণের বাইরে গিয়ে মৌলভিত্তির প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শুধু মূলধনকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ অস্বাভাবিকতা তৈরি করেছে। এরই অংশ হিসেবে কিছু কিছু স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ার গত দুই মাসের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ২৫০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ এর পেছনে কারণ জানতে চেয়ে পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসার জবাবে কোম্পানিগুলো কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। সম্প্রতি এ জাতীয় ঘটনা ঘটেছে পুঁজিবাজারে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি আনোয়ার গ্যালভেনাইজিংয়ের ক্ষেত্রে ।

গত ২৭ অক্টোবর কোম্পানিটির বিগত অর্থবছরের আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করে। ডিএসই ওয়েবসাইটে ওই দিন প্রকাশ করা তথ্যে দেখা যায় কোম্পানিটি বিগত অর্থবছরে (১ জুলাই ২০২৪- ৩০ জুন ২০২৫ ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১২ টাকা ৩২ পয়সা। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৩৮ পয়সা। অথচ ওই দিনই কোম্পানিটির শেয়ারের দর বেড়েছে ২৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। একদিন আগে ৬৩ দশমিক ৪০ টাকায় লেনদেন হওয়া শেয়ারের দাম গতকাল পৌঁছে যায় ৭৮ দশমিক ১০ পয়সায়।

কোম্পানিটি গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরই চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই- সেপ্টেম্বর ২৫) আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করে। এতে কোম্পানিটি আগের বছরের একই সময়ের দশমিক ৮৮ টাকা লোকসানের বিপরীতে এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে আয় দেখিয়েছে ২ দশমিক ৮৬ টাকা, যা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ দেখিয়েছে নন-অপারেটিভ মুনাফা হিসাবে। আর এটাকে পুঁজি করেই ওই দিন সার্কিট ব্রেকার না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দর বেড়ে ঘটেছে ২৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। অথচ এটি কোনো কোম্পানির নিয়মিত আয়ের অংশ নয়। নন-অপারেটিভ আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে কোম্পানি সচিব তৌহিদুল ইসলামের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, এ আয় এসেছে তাদের কিছু পরিত্যক্ত জিনিস বিক্রি ও পুঁজিবাজারে শেয়ারের বিনিয়োগ থেকে।

এক বছরে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারপ্রতি ১২ দশমিক ৩২ টাকা লোকসানে থাকা একটি কোম্পানির সাময়িক এ আয় কিভাবে কোম্পানির শেয়ারদর ২৩ শতাংশ বৃদ্ধিকে যৌক্তিক বলা যায়? নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে এ প্রশ্ন রাখা হয়েছিল একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিকিউরিটিজ হাউজের প্রধান নির্বাহীর কাছে। নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, এটাই এখন আমাদের পুঁজিবাজার। এখানে মৌলভিত্তি নয়, হুজুগই কাজ করে বেশি। আর এভাবেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করে চলেছে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও বাজারদরে তার খুব একটা প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। কিন্তু ১ বা ২ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করা কোম্পানির দর বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। এ আচরণ যত দিন পরিবর্তন না হবে তত দিন পুঁজিবাজার থেকে ভালো কিছু আশা করা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, কিছু কিছু কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেই বিনিয়োগকারীদের এক অংশ এ ধরনের অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে। অথচ এ কোম্পানিগুলোর মালিকরাই দেশের ব্যবসা ও বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে যেসব কোম্পানির ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে এসব কোম্পানির পেছনে রয়েছেন তারাই। তাই আইনের পাশাপাশি নৈতিক অবস্থান থেকেও পুঁজিবাজারকে বিবেচনায় নেয়া এখন সময়ের দাবি।