আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামী শাসনামলের নিয়োগকৃত ব্যক্তিরা নানা ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মাদরাসাগুলোতে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরির আড়ালে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। বিশেষ করে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফল তাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষক ও এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্টরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সুচিন্তিত মতামত বিবেচনা করবেন। এদের অর্থের বিনিময়ে বা কোনো মতাদর্শের টানে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজে যে লাগানো যাবে না, তা স্পষ্ট অনুধাবন করেছে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাটি। হাসিনা সরকারের পতনে রাজপথের আন্দোলনে মাদরাসাছাত্রদের অকুতোভয় ও অদম্য প্রতিরোধের বিষয়টি লক্ষ রেখে এখন বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোকে টার্গেট করা হয়েছে। কারণ আগামী নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণে মাদরাসাগুলোকেই নিউক্লিয়াস শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ষড়যন্ত্রের টিপ অব দ্য আইসবার্গ : প্রশাসনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্তত এক হাজার ৭০০ মাদরাসার ব্যবস্থাপনা দেখভাল করে। তাই প্রথম টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। মাদরাসাকেন্দ্রিক ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যে আওয়ামী শাসনামলে নিয়োগকৃত ব্যক্তি, গোষ্ঠীস্বার্থে জড়িত সংগঠনের নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের অভ্যন্তরে বাম রাজনীতির ধারার কর্মকর্তা ছাড়াও একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দু’জন শীর্ষ নেতা এবং একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের মাধ্যমে গড়ে ওঠা চক্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতেছে। ওই দু’জন রাজনৈতিক নেতার একজন অপহরণের শিকার হওয়ার পর ভারতের শিলংয়ে বেশ কয়েক বছর অবস্থান করেন। আরেক শীর্ষ নেতা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের নেতৃত্বে এ চক্রটি বিভিন্ন মাদরাসা সফর করে অনেকটা বিভেদ সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে উল্লিখিত জাতীয় দৈনিকটির প্রতিষ্ঠাতার নেতৃত্বে একসময় মাদরাসা আন্দোলন ও এ ধরনের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রসারের যে গৌরব ছিল, তা এখন চক্রটির কারসাজিতে ম্লান হতে শুরু করেছে।
আলিয়া বনাম কওমি : বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাটির নীল নকশা অনুযায়ী দেশের আলিয়া ও কওমি মাদরাসার মধ্যে বিভেদ তীব্র করা হচ্ছে কৌশলে। নির্বাচনকে সামনে রেখে আলিয়া ও কওমি মাদরাসার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে যাতে এসব মাদরাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। কারণ মাদরাসার শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের কাছে পরম শ্রদ্ধাভাজন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থী বিবেচনার বিষয়ে ছাত্রদের ওপর শিক্ষকদের ব্যাপক প্রভাব থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন মাদরাসায় নগদ অনুদান, জমি বা অন্যান্য ব্যক্তিগত সুবিধার মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। এ কাজে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অতীতে শেখ হাসিনাকে যারা কওমি জননীর উপাধি দিয়েছিলেন, সেই ঘরানার কেউ কেউ।
ইসলামী জোটে ভাঙনের অপচেষ্টা : অতীতে হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতপার্থক্যের উত্থান-পতন ঘটতে দেখা গেছে কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এবারো একই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বিদেশী সংস্থাটি। কোনোভাবেই একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বিপরীতে ইসলামী দলগুলো যাতে অভিন্ন নির্বাচনী জোট করে টিকে থাকতে না পারে সে জন্য রাজনৈতিক সংলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যড়যন্ত্রকারীরা। তারা কোনো বিশেষ ইসলামী দলের বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য দিয়ে উসকানি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, যাতে নির্বাচনে ইসলামী জোটকে সহজেই ভাঙা যায়। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা হয়েও দেশী ও বিদেশী মিডিয়ার কাছে অমুক রাজনৈতিক দল অতটি আসন চেয়েছিল, রাজি না হওয়ায় তারা নাখোশ হয়ে নির্বাচনের বিরুদ্ধে অচলাবস্থার পাঁয়তারা করছে- এমন আকর্ষণীয় বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
মিডিয়া যেন কাবাব মে হাড্ডি : ইসলামী দলগুলোর কোনো শক্তিশালী মিডিয়া নেই। এর মধ্যে সংবাদমাধ্যম এ ধরনের রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক এতটাই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যে ইসলামী দলের নেতার মধ্যেও মিডিয়া নিয়ে একধরনের অস্বচ্ছ ধারণা ও বৈরী মনোভাব কাজ করে। বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা এ সুযোগটি এবারো নির্বাচনের আগে কাজে লাগাচ্ছে। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির কেনো এত ভোট পেল সেই রহস্য খুঁজে পেতে মিডিয়াগুলো কৌশলে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা, শরিয়াহ আইন, ক্ষমতায় এলে কিভাবে দেশ পরিচালনা করা হবে ইত্যকার প্রশ্ন ছুড়ে কৌশলে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ছড়াচ্ছে। এ দিক থেকে বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশো উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছে। এত দিন হিজাব ও নিকাব নিয়ে মিডিয়া তার প্রচলিত ধারণা পাল্টে উল্টো রথযাত্রা শুরু করেছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, কেন পর্দা করেননি বা ইসলামের অনুশাসন মানেন না এমন প্রার্থীকে মাঝখানে বসিয়ে দুই পাশে শিবিরের নেতারা বসছেন।
হেফাজত কি স্বর্ণের হরিণ : একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতারা হেফাজতের ইসলামের নেতাদের কাছে যাচ্ছেন। তারা শলাপরামর্শ করছেন। লক্ষ্য একটাই নির্বাচনে তারা হেফাজতের সমর্থন চান। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সাক্ষী আছে আপসহীন নেত্রীর উদাত্ত আহ্বানের পরও শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের পাশে এসে দাঁড়াননি এই বৃহৎ দলের নেতাকর্মীরা। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ওই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নেত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়ালে তাদের পাখির মতো গুলি করে মারা সম্ভব হতো না; বরং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা ইতিহাসই পাল্টে যেত।
প্রশ্ন উঠেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলের কাছে হেফাজতে ইসলাম এখন কি ফের স্বর্ণের হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ধারণা আগামী নির্বাচনের ফলাফলে একটি বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে এই ধাববান স্বর্ণের হরিণ। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই’- এমনি মনোভাবে লেবাস পরিবর্তন করে তারা ছুটছেন হেফাজতের নেতাদের মন গলাতে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাদরাসায় রূপান্তরিত!
সম্প্রতি এ ধরনের উদ্ভট অথচ মুখরোচক অভিযোগ তুলেছেন কয়েক দশকের আওয়ামী নেতা ও দল পরিবর্তনকারী ফজলুর রহমান। তার দাবি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলিয়া মাদরাসার ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ করে দিয়ে শেখ হাসিনা সর্বনাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভরে যাচ্ছে মাদরাসাছাত্রদের দিয়ে। অথচ যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে মাদরাসা ছাত্ররা যে শিক্ষার সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছেন, নৈতিকতার দিক থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সে দিক থেকে দৃষ্টি সরাতেই এ ধরনের অপপ্রচার করা হচ্ছে। এ ধরনের অপপ্রচারও সামগ্রিক মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলে তাদের বিপরীত মতাদর্শের ভোটারদের নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির অপকৌশল হিসেবেই করা হচ্ছে।