ব্যাংকের হিসাব-নিকাশের ব্যস্ত দিনের অবসানে যখন বেশির ভাগ মানুষ বিশ্রাম খোঁজেন, তখন এক ভিন্ন স্বপ্নের পিছু ছুটছেন ব্যাংকার হাসান আল ফারুক। মূল পেশা ব্যাংকে হলেও কৃষিকে ভালোবেসে গড়ে তুলেছেন একটি হাঁসের খামার। শরীয়তপুরে চাকরিরত অবস্থায় হাঁস পালন দেখে মুগ্ধ হন তিনি। সেই থেকেই স্বপ্ন- একদিন নিজেও করবেন একটি আধুনিক খামার। সেই স্বপ্নের জোয়ারেই মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর গ্রামে নিজের বাড়ির পাশে গড়ে তুলেছেন তার ‘স্বপ্নের হাঁসের খামার’।
প্রথমে খাঁকি ক্যাম্বেল জাতের ৫০০ হাঁসের বাচ্চা কিনে যাত্রা শুরু করেন ফারুক। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ঠাণ্ডাজ্বরে মারা যায় ৪০টি বাচ্চা। তবুও পিছিয়ে যাননি তিনি। নিয়ম অনুযায়ী টিকা দেয়া, পানি-খাদ্যে ভিটামিন মেশানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা- সবকিছু কঠোরভাবে মেনে চলতে শুরু করেন তিনি। ফলে শুরুতে ক্ষতির মুখে পড়লেও পরে আর কোনো হাঁস মারা যায়নি। ধীরে ধীরে খামারে ফিরে আসে স্থিতি ও গতিশীলতা।
চার মাসের মাথায় হাঁসগুলো ডিম দিতে শুরু করে। বর্তমানে খামারের ৪৬০টি হাঁস থেকে প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে ৩৫০-৩৬০টি ডিম। স্থানীয় বাজারে ডিমের প্রচুর চাহিদা থাকায় সেখানেই বিক্রি করেন তিনি তার খামারের সব ডিম। মাস শেষে ডিম বিক্রি করে তার আয় হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। খরচ বাদে ফারুকের নিট লাভ থাকে ৫০-৬০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক জলাশয়ে হাঁস চরানোর সুযোগ পেলে এই লাভ আরো বাড়তে পারত।
তিনি জানান, খামার পরিচালনায় ফারুককে নিতে হয়েছে বাড়তি ঝুঁকি। বাড়ির আশপাশে প্রাকৃতিক কোনো জলাশয় নেই। কাছের খালটিও প্রভাবশালীরা দখলে রেখে মাছ চাষ করছেন। তাই সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি হাঁস নামাতে পারেন না। তিনি তার নিজস্ব পাঁচ শতক জমি সুতার নেট দিয়ে ঘিরে হাঁসের জন্য বানিয়েছেন নিরাপদ ঘের। তৈরি করেছেন গোসল ও পানি পানের জন্য লম্বা চৌবাচ্চা ও ডিম পাড়ার উপযোগী টিন শেড ঘর। সবকিছুই নিজের ভাবনায় সাজানো হয়েছে তার খামার।
ব্যাংকের চাকরির ব্যস্ততার কারণে খামার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন তার বাবা। খাবার দেয়া, পানি পরিবর্তন, খামারের পরিচ্ছন্নতা- সবই তিনি করেন নিয়মিত ও যতেœর সাথে। বাবা-ছেলের এই যৌথ প্রচেষ্টাই খামারটিকে লাভজনক করে তুলেছে। ডিম উৎপাদনের পাশাপাশি ফারুকের মনে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয় মানসিক তৃপ্তি- যা ব্যাংকের চাকরিতে তিনি পান না। তার মতে, কৃষি শুধু ব্যবসা নয়; এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক সহজাত সম্পর্ক। পরিশ্রম, ধৈর্য ও পরিকল্পনা থাকলে এটি ভবিষ্যৎ গড়ার এক শক্তিশালী খাত।
ফারুক বলেন, প্রথম দিকে বাধা ছিল অনেক। কিন্তু সংকল্প থাকলে কোনো বাধাই কাউকে থামাতে পারে না। ভবিষ্যতে খামার আরো বড় আকারে বিস্তারের পরিকল্পনা আছে।
মেহেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো: তোফাজ্জল হোসেন জানান, নিয়ম মেনে পরিচর্যা করলে হাঁস পালন এখন একটি লাভজনক খাত। ফারুকের মতো তরুণরা এগিয়ে আসায় কৃষির নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, হাঁস বা পোলট্রি খামার গড়তে যারা আগ্রহী, প্রাণিসম্পদ দফতর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, ভ্যাকসিন ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে।
একজন ব্যাংকারের সাহস, পরিশ্রম আর দৃঢ়তায় গড়ে ওঠা এই খামার এখন এলাকায় অনুকরণীয় মডেল। প্রমাণ করেছে- স্বপ্ন যদি মাটিতে শেকড় গাড়ে, তবে সেটিই একদিন ডানা মেলে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।



