খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশ

আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা ও রাজনৈতিক পদ বাতিলের প্রস্তাব

খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই দৃশ্যমান অগ্রগতি না দেখাতে পারলে ব্যাংকগুলোকে আরো কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

দেশের ব্যাংক খাতে চলমান অস্থিতিশীলতার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ। এর প্রভাব এখন শুধু কোনো একক ব্যাংকের ব্যালান্সশিটে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পুরো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ পরিবেশ সরাসরি হুমকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই দৃশ্যমান অগ্রগতি না দেখাতে পারলে ব্যাংকগুলোকে আরো কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে।

ব্যাংকার্স সভায় গভর্নরের কঠোর বার্তা

রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভাটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে-

  • চলতি বছরের আর্থিক বিবরণীতে খেলাপি হার আর বাড়লে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে,
  • ঋণ বিতরণ থেকে আদায়, সবপর্যায়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আরো জোরদার করতে হবে,
  • উচ্চঝুঁকির ঋণ আগেই শনাক্ত করে দ্রুত পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন কোনো ঋণ এখন খেলাপি অবস্থায় গেলে তা সরাসরি ব্যাংকের অবহেলা হিসেবেই দেখা হবে।’

২% ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের পুনঃতফসিল, ব্যাংকারদের কঠোর বিরোধিতা

বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ নীতি সহায়তার আওতায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছরের পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে। উদ্দেশ্য অতি দ্রুত খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা।

কিন্তু ব্যাংকাররা এই নীতি নিয়ে সরাসরি আপত্তি তুলেছেন। তাদের ব্যাখ্যা-

  • ঘন ঘন বিশেষ সুবিধা দিলে ঋণগ্রহীতারা নিয়মিত পরিশোধের আগ্রহ হারান
  • বারবার ছাড়ের কারণে খেলাপিরা ‘অপেক্ষার খেলায়’ থাকেন, পরিশোধ নয়, কবে নতুন ছাড় আসবে
  • অতীতে এই সুবিধার বেপরোয়া অপব্যবহার হয়েছে।
  • নিয়মিত গ্রাহকরাও উদ্দেশ্যমূলকভাবে খেলাপি হয়ে সুবিধা নিয়েছেন।
  • এর ফলে কাগজে-কলমে খেলাপি কমানো গেলেও বাস্তবে আদায়ের হার বাড়েনি।

একজন ব্যাংকের এমডি ক্ষোভের সাতে বলেন, ‘এভাবে পুনঃতফসিল শুধু সময় কেনা, আদায় নয়।’

রাজনৈতিক প্রভাব, খেলাপি আদায়ের ‘সবচেয়ে বড় বাধা’

বৈঠকে অংশ নেয়া প্রায় সব এমডিই একযোগে একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক প্রভাব।

তাদের সরাসরি অভিযোগ-

  • অনেক খেলাপি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আইনগত প্রক্রিয়ায় স্পর্শযোগ্য নন।
  • নোটিশ পাঠানো, মামলা করা বা জামানত বিক্রির উদ্যোগ নিলেই ‘ফোন আসে’।
  • রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণে খেলাপিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
  • আদায় প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ব্যাংকের সাধারণ গ্রাহক ও আমানতকারীর অর্থ ঝুঁকিতে পড়ে।

এমডিদের দাবি ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে খেলাপি নিয়ন্ত্রণের সব উদ্যোগই ব্যর্থ হবে।’

তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন-

রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে : ঋণ আদায়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলবে না, খেলাপিদের ‘দলে দলে আশ্রয়’ বন্ধ করতে হবে।

খেলাপি হলে রাজনৈতিক দল থেকে সদস্যপদ বাতিল, ব্যাংকারদের প্রস্তাব

বৈঠকে কিছু ব্যাংকের এমডি আরো কঠোর প্রস্তাব দেন।

যেহেতু এখন খেলাপিরা জাতীয় নির্বাচন করতে পারেন না, ব্যাংকের উচ্চপদেও থাকতে পারেন না, রাজনৈতিক দলেও একই নিয়ম থাকা উচিত-

ঋণখেলাপি হলে সদস্যপদ বাতিল।

ব্যাংকারদের যুক্তি-

  • রাজনৈতিক পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে খেলাপিরা দায়মুক্তি পান।
  • খেলাপি হলে সদস্যপদ ঝুঁকিতে পড়লে কেউ আর রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে ঋণ না দেয়ার প্রবণতায় যাবে না।
  • এতে রাজনৈতিক দলগুলোতেও আর্থিক শৃঙ্খলার সংস্কৃতি তৈরি হবে।

এই প্রস্তাব ব্যাংকারদের হতাশা এবং দীর্ঘ দিনের অচলাবস্থার একটি প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

‘প্রভাবশালী সম্পত্তি’ নিলামে ওঠা মানেই শূন্য দরদাতা

ব্যাংকাররা আরো জানান

  • প্রভাবশালী খেলাপিদের সম্পত্তি নিলামে উঠলে কেউ অংশ নিতে সাহস পান না
  • নিলাম আয়োজনের সব ব্যয় ব্যাংককেই বহন করতে হয়
  • শেষ পর্যন্ত নিলাম ‘নামসর্বস্ব’ থেকে যায়, ব্যাংক আদায় করতে পারে না
  • ফলে খেলাপি ও সুদ জমতে থাকে, ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি পায়

ব্যাংকাররা দাবি করেছেন, নিলাম প্রক্রিয়া নিরাপদ করা ও কার্যকর করতে আইনগত ক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে।

বন্ধ কোম্পানি পুনরুজ্জীবন, চলমান ব্যবসাকে জামানত করার নির্দেশ

ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক আরো নির্দেশ দিয়েছে :

  • যারা বন্ধ হয়ে খেলাপি হয়েছে, সেই কোম্পানি পুনরায় সচল করার জন্য ঋণ পুনঃগঠন ও নীতি সহায়তা দিতে হবে
  • প্রয়োজনে উদ্যোক্তাদের সাথে সরাসরি বৈঠকে বসতে হবে
  • যারা ব্যবসা চালাচ্ছেন কিন্তু খেলাপি, তাদের চলমান ব্যবসা অতিরিক্ত জামানত হিসেবে যুক্ত করতে হবে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, এটি খেলাপি আদায়ে একটি ‘বিজনেস রিকভারি অ্যাপ্রোচ’, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হতে পারে।

বড় ঋণের ঝুঁকি কমাতে এসএমইতে জোর

বৈঠকে বড় অঙ্কের ঋণে ঝুঁকি কেন্দ্রীয়ভূত হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ

  • কয়েকটি বড় খাতে বিপুল ঋণ অতি কেন্দ্রীয়ভূত
  • এতে ব্যাংক খাত সিস্টেমিক রিস্কের মুখে পড়ে
  • সমাধান হিসেবে ব্যাংকগুলোকে এসএমই, উৎপাদন, কৃষি ও আঞ্চলিক খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে হবে

এটি করতে পারলে ঋণ পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আসবে, ঝুঁকি কমবে।

সমস্যার মূল তিন স্তর

এই বৈঠক ও নির্দেশনা বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের খেলাপি সঙ্কট আসলে তিন স্তরবিশিষ্ট :

১. কাঠামোগত ব্যর্থতা : দুর্বল মূল্যায়ন, অপর্যাপ্ত নজরদারি; বোর্ড পর্যায়ে স্বার্থজড়িত সিদ্ধান্ত ও ঋণের উচ্চ কেন্দ্রীয়ভবন।

২. আইনগত দুর্বলতা : মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা; দেউলিয়া আইন অকার্যকর; দায়মুক্তির সুযোগ অনেক।

৩. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ : বহু খেলাপি ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ অবস্থানে; স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ব্যবহার করে পরিশোধ এড়িয়ে যান এবং এতে সুশাসন ভেঙে পড়ে, খারাপ প্র্যাকটিস উৎসাহিত হয়।

এ কারণে ব্যাংকাররা এখন কঠোর ভাষায় বলছেন, ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে খেলাপি সঙ্কট কখনই কমবে না।’

খেলাপি সঙ্কট এখন রাজনৈতিক-আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন

বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, কিন্তু এটি মাত্র প্রথম ধাপ।

যদি রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ না হয়, আইন কঠোর ও দ্রুত প্রয়োগ না হয়, নিয়মিত পরিশোধকারীদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত না হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পাহাড় আরেকটি বড় আর্থিক ‘শক’ সৃষ্টি করার ঝুঁকিতে রয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ যে সঙ্কেত দিচ্ছে তা স্পষ্ট- এটি আর কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, আইনি কাঠামোর শক্তি ও রাষ্ট্রীয় সুশাসনের পরীক্ষা।